পাঠ্যবইয়ে ভুল: রিউমর স্ক্যানারের তিন ফ্যাক্টচেকেই সংশোধনী 

বাংলাদেশের পাঠ্যবইগুলোতে ভুলের প্রবণতার বিষয়টি নিয়ে গেল কয়েক বছর ধরেই আলোচনা ও সমালোচনা হয়ে আসছে। বিশেষত গত বছর থেকে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরুর পর এই কারিকুলামের আওতায় প্রণীত নতুন বইয়ের বিষয়েও সর্বত্রই আলোচনা চলেছে৷ গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম চালু হওয়ার পর চলতি বছর থেকে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার গেল বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরও পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলের বিষয়ে কাজ করেছে। এর প্রেক্ষিতে নতুন কারিকুলামে অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) বইয়ের একটি ভুল নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। বইটির ৩য় অধ্যায়ের (পরমাণুর গঠন) ২৮ নং পৃষ্ঠায় পরমাণু এবং পারমাণবিক মডেলের ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশ শিরোনামের প্যারায় একটি চিত্র দেওয়া হয়েছিল, যেখানে একটি নিউক্লিয়াস এঁকে হিলিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের অবস্থান দেখানো হয়েছিল। 

চিত্রটির চিহ্নিতকরণ অংশে দাবি করা হয়, হালকা লাল (ধনাত্মক চার্জ) চিহ্নিত অংশটি ইলেকট্রন, হালকা আকাশী (চার্জ নিরপেক্ষ) চিহ্নিত অংশটি প্রোটন এবং হালকা কমলা (ঋণাত্মক চার্জ) চিহ্নিত অংশটি নিউট্রন। এই চিহ্নিতকরণে মাধ্যমে এটাই বোঝাচ্ছে যে, হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের বাইরের অংশে ঘূর্ণায়মান থাকে নিউট্রন এবং ভেতরের অংশে ইলেকট্রন ও প্রোটনের অবস্থান।  

Screenshot: Class 8 Science Book

রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, বইয়ের এই চিত্রটির চিহ্নিতকরণ সঠিকভাবে করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, নিউক্লিয়াসের ভেতরে ঘূর্ণায়মান রয়েছে ধনাত্মক চার্জের প্রোটন এবং চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রন। এছাড়া, নিউক্লিয়াসের বাইরের অংশে ঘূর্ণায়মান রয়েছে ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন। চিহ্নিতকরণের ভুলে প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রনের ভুল অবস্থান দেখানো হয়েছে বইটিতে।

গত ০৮ মে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে পাঠ্যবইয়ের এই ভুল সংশোধনের কথা জানানো হয়েছে৷ 

Screenshot: DSHE Website 

স্কুলগুলোতে পাঠানো এই সংশোধনী শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ পাঠ্যবইয়ে সংযোজন করার অনুরোধ করেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম। 

চলতি বছর নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন বই পৌঁছানোর পর এই শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটি মানচিত্র নিয়ে বেশ সমালোচনা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার৷ বইটির ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ নামক অধ্যায়ের ১৪৯ নং পৃষ্ঠায় ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরাইল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিশর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে। বইটিতে দাবি করা হয়, এই মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে।

Screenshot: Class 9 History & Social Science Book

তবে রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে জেনেছে, এই মানচিত্রটি মূলত জেরিকো নগরীর বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে উপস্থাপন করা হলেও একই মানচিত্রে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের দেশ ও অঞ্চলকে স্থান দেওয়া হয়েছে। জেরিকো নগরীর উত্থানকালে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জুডিয়া, ইসরাইল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া বা জর্ডানের বর্তমান পরিচয়, অবস্থান বা সীমানার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু মানচিত্রটিতে এদের অবস্থানও জেরিকোর সাথে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। সামারা এবং জুডিয়া রাজ্যের উৎপত্তি সেসময় ঘটেনি। তাই সেসময়ের মানচিত্রে এদের অবস্থান থাকার কথা নয়। অন্যদিকে বাকি যে স্থানগুলোর অবস্থান দেখানো হয়েছে সেগুলোর উৎপত্তি গত শতাব্দীতে। তাই এদের অবস্থানও এই মানচিত্রে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে। তাছাড়া, মানচিত্রে গাম্বিয়া নামে যে স্থানটিকে নির্দেশ করা হয়েছে সেখানে গাম্বিয়া নয়, রয়েছে গাজার অবস্থান।

নবম শ্রেণির এই বইটির রচনা ও সম্পাদনা দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম। আমরা তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। জনাব আকসাদুল আলম রিউমর স্ক্যানারকে বলছিলেন, “বইটা দুইটি কন্টেন্ট নিয়ে করা। একটি ইতিহাসের, অন্যটি সামাজিক বিজ্ঞানের। ইতিহাসের অংশটা আমি দেখিনি। আমার ধারণা, সম্ভবত কোনোভাবে ভুল একটি মানচিত্র ছাপা হয়েছে, যেখানে কন্টেন্টের সাথে মিলও নেই৷”

গত ০৮ মে স্কুলগুলোতে যে সংশোধনী পাঠানো হয়েছে তাতে আলোচিত এই মানচিত্রসহ এই পেজটিই বাদ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

Screenshot: DSHE Website

রিউমর স্ক্যানার চলতি বছর নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের একাধিক ভুল নিয়েও কাজ করেছে। এই শ্রেণির ‘বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ)’ বইয়ের ‘জৈব অণু’ (৯ম অধ্যায়) নামে একটি অধ্যায়ের ১৩৭ নং পৃষ্ঠায় ‘কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা’ শিরোনামের পাঠের ৯.৩ নং চিত্রে গ্লুকোজের দুইটি চিত্রের প্রথমটিতে কার্বন ৬ টি, হাইড্রোজেন ১০ টি ও অক্সিজেন ৫ টি দেখানো হয়েছে।

এছাড়া, একই অধ্যায়ের ১৪০ নং পৃষ্ঠায় ‘ডিএনএ’ শিরোনামের পাঠের ৯.৫ নং চিত্রে ডিএনএর নাইট্রোজেন বেসের গঠনের একটি ছবি রয়েছে যাতে গুয়ানিন এবং থাইমিনের গঠনে একটি করে হাত খালি দেখা যাচ্ছে।

তাছাড়া, একই পৃষ্ঠায় দাবি করা হয়েছে, ডিএনএর রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারের জন্য ওয়াটসন ও ক্রিক ১৯৬৩ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। 

Screenshot: Class 9 Science Book

রিউমর স্ক্যানার টিমের যাচাই করে দেখেছে, ‘বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ)’ বইয়ের ‘জৈব অণু’ নামের অধ্যায়ে গ্লুকোজ, গুয়ানিন ও থাইমিনের যে চিত্র রয়েছে তা সঠিক নয় এবং ডিএনএ নিয়ে পাওয়া নোবেল পুরষ্কারের বিষয়ে দেওয়া তথ্যও ভুল। প্রকৃতপক্ষে, গ্লুকোজের চিত্রে ১০টি হাইড্রোজেন ও ৫টি অক্সিজেন এবং গুয়ানিনে একটি নাইট্রোজেন এবং থাইমিনে H2C বসবে। তাছাড়া, একই পৃষ্ঠায় ডিএনএর রাসায়নিক গঠন আবিষ্কারের জন্য ওয়াটসন ও ক্রিক ১৯৬৩ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বলে যে দাবি করা হয়েছে তাও সঠিক নয়। কারণ তারা নোবেল পান ১৯৬২ সালে। একই বিষয়ে নোবেল পাওয়া তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে মরিস উইলকিনসের নামও বাদ পড়েছে বইটি থেকে।

স্কুলগুলোতে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এই বিষয়েও সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। তবে ১৩৭ পৃষ্ঠার ‘কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা’র চিত্র, ১৪০ পৃষ্ঠার ‘ডিএনএ’ এর চিত্র এবং নোবেল পাওয়ার সালের বিষয়ে সংশোধনী দেওয়া হলেও একই বিষয়ে নোবেল পাওয়া তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে বাদ পড়া মরিস উইলকিনসের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে কোনো সংশোধনী দেওয়া হয়নি। 

Screenshot: DSHE Website

অর্থাৎ, পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুল তথ্য নিয়ে চলতি বছর রিউমর স্ক্যানার তিনটি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সম্প্রতি স্কুলগুলোতে যে সংশোধনী দিয়েছে তার মধ্যে এই তিন ফ্যাক্টচেকের ভুলগুলোর বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে।  

রিউমর স্ক্যানার টিম আগামীতেও পাঠ্যবইয়ের ভুলের বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। 

আরও পড়ুন

spot_img