দেশে চলতি বছর থেকে নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। নতুন কারিকুলামের ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটি ভুল নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে সমালোচনা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
যে ভুল নিয়ে আলোচনা
নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ নামক অধ্যায়ের ১৪৯ নং পৃষ্ঠায় ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরাইল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিশর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে।
বইটিতে দাবি করা হচ্ছে, এই মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে।
এ সংক্রান্ত পাঠে লেখা রয়েছে, “ইতিহাসবিদদের মতে, নগরায়ণের সর্বপ্রথম বিকাশ ঘটে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার জর্ডন নদী উপত্যকায় অবস্থিত জেরিকো নামক স্থানে।” (বানান অপরিবর্তিত)
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান সম্বলিত যে মানচিত্রটি দেখানো হয়েছে তা সঠিক নয় বরং জেরিকো নগরীর অবস্থান নির্দেশ করতে গিয়ে মানচিত্রে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়কালের স্থানকে নির্দেশ করা হয়েছে। তাছাড়া, মানচিত্রে গাম্বিয়া নামে যে স্থানটিকে নির্দেশ করা হয়েছে সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া নয়, রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার অবস্থান।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত মানচিত্রে থাকা গাম্বিয়ার অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির ২০০৫ সালের একটি প্রতিবেদনে এবং বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ওয়েবসাইটের একটি নিবন্ধে একই স্থানের মানচিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এই মানচিত্রগুলোতে গাম্বিয়ার স্থলে গাজা’র অবস্থান দেখানো হয়েছে।
শুধু আন্তর্জাতিক সূত্রই নয়, খোদ ইসরায়েল সরকারের ওয়েবসাইটেও একই অবস্থানে গাজাকে চিহ্নিত অবস্থায় দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে আমরা দেখেছি, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া থেকে গাজার বর্তমান অবস্থানের দূরত্ব প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। (১, ২)।
অর্থাৎ, পাঠ্যবইয়ে গাজার অবস্থানকে গাম্বিয়া হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
বৈশ্বিক জিওগ্রাফি বিষয়ক ওয়েবসাইট World Atlas এ আমরা একই স্থানের একটি মানচিত্র খুঁজে পেয়েছি যাতে দেখা যাচ্ছে, জেরিকো নগরীটি বর্তমানে পশ্চিম তীর (West Bank) এর অন্তর্ভুক্ত। পাঠ্যবইয়ে অবশ্য এই পশ্চিম তীরের অবস্থানও উল্লেখ করা হয়নি।
মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থট এন্ড সিভিলাইজেশ্যন (International Institute of Islamic Thought and Civilization) এর পিএইচডি ক্যান্ডিডেট আসিফ আদনান বলছেন, “বইয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রথম নগরায়নের। এর উদাহরণ হিসেবে আনা হচ্ছে জেরিকো-র কথা। যেটার সময়কাল হল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০০-৯৫০০। (সময়কাল নিয়ে নানা মত আছে।) এর সাথে আবার দেখানো হচ্ছে ‘জুড়িয়াহ’, সামারা, ‘ইস্র–‘ – অথচ ঐ টাইমলাইনে এগুলো ছিল না। এগুলো আরও পরের কথা।”
আসিফ জানাচ্ছেন, তানাখের বক্তব্য অনুযায়ী সল (তালুত) এর অধীনে কিংডম অফ ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা হয়। সুলাইমান (আঃ) এর মৃত্যুর পর কিংডম অফ ইসরায়েল দুই ভাগ হয়। এক ভাগের নাম কিংডম অফ জুডাহ, আরেক ভাগের নাম কিংডম অফ সামারিয়া/কিংডম অফ ইসরায়েল। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে এই দুই রাজ্যের সময়কাল হল খ্রিষ্টপূর্ব ৯৩০-৭২০। এর বহু পরে সিলিউসিডদের বিরুদ্ধে বনী ইসরাইল বিদ্রোহ করে জুডিয়া নামে একটা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠন করে খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৭ এর দিকে।
জনাব আসিফের মতে, “যদি ভুল করে খ্রিষ্টপূর্ব ৯৭০ এর দিকের ম্যাপই দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে এখানে ‘জেরিকা’ আর ‘জুড়িয়াহ’ এর আশেপাশে থাকবে আম্মোন, ইডোম, মোয়াব, আসিরিয়াদের রাজ্যের নাম। ঐ সময়ে এগুলোই ছিল পার্শ্ববর্তী রাজ্য। অথচ আশেপাশে দেখানো হয়েছে মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন আর গাম্বিয়াকে! যেগুলোর আধুনিক বর্ডার হয়েছে ১৯৪৬ এর পর।”
আসিফ বলছেন, (পাঠ্যবইয়ের) লেখাতে এক টাইমলাইনের কথা বলা হচ্ছে। ছবির এক অংশে (‘জুড়িয়াহ-জেরিকা’) আরেক টাইমলাইন দেখানো হচ্ছে। আশেপাশের দেশের জায়গায় দেখানো হচ্ছে তৃতীয় আরেক টাইমলাইন। এভাবে এক ছবিতে (মানচিত্রে) আটকা পড়ে গেছে তিন টাইমলাইন (প্রাচীন জেরিকো নগরী – আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০০-৯৫০০, জুডিয়া/সামারা দুই রাজ্য – আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৯৭০-৭২০, আশেপাশে মিশর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান – ১৯৪৬ এর পরে।) আর দুই মহাদেশ।
রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদের সাথে, যিনি ‘ইসরাইলের উত্থান-পতন’ এবং ‘ইহুদী জাতির ইতিহাস’ নামে দুইটি বইয়ের লেখক। তিনিও আসিফের সাথে একমত। বলছিলেন, “এই মানচিত্রের মূল সমস্যাটিই হলো বিভিন্ন টাইমলাইনকে এক করে ফেলা, তাছাড়া জায়গাগুলোর নামও সঠিক জায়গায় চিত্রিত হয়নি, যেমন গাজার জায়গায় গ্যাম্বিয়া এখানে আসবার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া, ‘জর্ডন’ বা ‘জুড়িয়া’-র মতো বানান বাংলাদেশি রীতি অনুসরণ করে না।”
আব্দুল্লাহ বলছেন, “জেরিকো নগরীর আরবি উচ্চারণ ‘আরিহা’ (أريحا), হিব্রুতেও কাছাকাছিই- ‘আরিহো’ (יְרִיחוֹ)। এর পূর্বে জর্ডান নদী আর পশ্চিমে জেরুজালেম। মিশর থেকে এ এলাকায় ফেরা ইসরাইলিরা কানান-দেশ বা পবিত্র ভূমি বিজয় অভিযান শুরু করেছিল এই জেরিকো নগরী অধিকার করার মধ্য দিয়ে। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী (খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সাল), জেরিকো অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জশুয়া বা ইউশা ইবনে নূন (আ)। বাইবেলের প্রাচীন সেই জেরিকো নগরীর বর্তমান স্থান তেল-এস-সুলতান বলা হয়ে থাকে।”
আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ এ সংক্রান্ত ইতিহাস টেনে বলেন, “ওল্ড টেস্টামেন্টে দাউদ (আ) ও তাঁর পুত্র সুলাইমান (আ)-এর সময় বনী ইসরাইলের রাজত্ব স্বর্ণশিখরে ছিল, ইয়াকুব (আ)-এর অপর নাম ‘ইসরাইল’ থেকে এ সাম্রাজ্যকে ইসরাইল রাজ্য বলা হতো। কিন্তু সুলাইমান (আ)-এর পুত্র রেহোবামের রাজত্বের সময় (খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক) ভেঙে যায় এ সাম্রাজ্য। উত্তরের রাজ্যের নাম হয় ইসরাইল রাজ্য, আর দক্ষিণের নাম হয় জুদাহ (Judah) রাজ্য। ইয়াকুব বা ইসরাইল (আ) এর চতুর্থ পুত্র ছিলেন জুদাহ বা এহুদা। যদিও নামে মনে হতে পারে, ইসরাইল রাজ্য হয়তো বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল, কিন্তু আসলে জুদাহ রাজ্যেই ছিল জেরুজালেম ও বাইতুল মুকাদ্দাস।”
“পরে রোমানরা এ অঞ্চল অধিকার করে নিলে সামারিয়া, ইসরাইল, জুদাহ- এসব মিলিয়েই তারা গঠন করে রোমান জুডিয়া প্রদেশ (খ্রিস্টীয় ৬ সাল)। ইহুদীদের কাছে কেবল দক্ষিণের অঞ্চল ‘জুদাহ’ হলেও, রোমানদের কাছে এই বৃহত্তর এলাকার নাম ছিল ‘জুডিয়া’ (Judea, Judaea)। অবশ্য একথা মাথায় রাখা জরুরি যে, দাউদ-সুলাইমান (আ)-এর ইসরাইল আর বর্তমানে গাজায় আগ্রাসন চালানো ইসরাইল এক নয়। এ অঞ্চলকে তখন জুডিয়া নামকরণ করা হলেও বহু আগে থেকেই এ অঞ্চল প্যালেস্টাইন (পেলেসেৎ) নামে পরিচিত, এমনকি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের লেখাতেও আমরা প্যালেস্টাইন পাই। মূলত এই প্রচলিত নাম থেকেই পরে রোমানরা সরকারিভাবেই নতুন নাম দেয়- ‘সিরিয়া প্যালেস্টিনা’; ১৩২ সালে ইহুদীদের রোমান-বিরোধী বার কোখবা বিদ্রোহের সময় জুডিয়া আরেকটু বড় হয় এবং তখনই রোমানরা এই ‘প্যালেস্টিনা’ নাম রাখে, জুডিয়া বা ইসরাইল নয়।”
আমরা ফিলিস্তিনের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান কাশিফ (Kashif) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিহাম আবু আইতা’র সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তিনি বলছিলেন, এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় যদি জাতিসংঘ প্রদত্ত মানচিত্র বইতে দেয়া হয়। এতে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়।
জাতিসংঘ প্রদত্ত উক্ত স্থানের মানচিত্র দেখুন এখানে।
নবম শ্রেণির এই বইটির রচনা ও সম্পাদনা দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম। আমরা তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। জনাব আকসাদুল আলম রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “বইটা দুইটি কন্টেন্ট নিয়ে করা। একটি ইতিহাসের, অন্যটি সামাজিক বিজ্ঞানের। ইতিহাসের অংশটা আমি দেখিনি। আমার ধারণা, সম্ভবত কোনোভাবে ভুল একটি মানচিত্র ছাপা হয়েছে, যেখানে কন্টেন্টের সাথে মিলও নেই৷”
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম গত ২৭ জানুয়ারি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি এ বিষয়টা মাত্র জানলাম। এ ধরনের ভুল হয়ে থাকলে অবশ্যই এটা পরিবর্তন হবে।
মূলত, নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরাইল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিশর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে। বইটিতে দাবি করা হচ্ছে, এই মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, এই মানচিত্রটি মূলত জেরিকো নগরীর বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে উপস্থাপন করা হলেও একই মানচিত্রে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের দেশ ও অঞ্চলকে স্থান দেওয়া হয়েছে। জেরিকো নগরীর উত্থানকালে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জুডিয়া, ইসরাইল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া বা জর্ডানের বর্তমান পরিচয়, অবস্থান বা সীমানার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু এদের অবস্থানও জেরিকোর সাথে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। সামারা এবং জুডিয়া রাজ্যের উৎপত্তি সেসময় ঘটেনি। তাই সেসময়ের মানচিত্রে এদের অবস্থান থাকার কথা নয়। অন্যদিকে বাকি যে স্থানগুলোর অবস্থান দেখানো হয়েছে সেগুলোর উৎপত্তি গত শতাব্দীতে। তাই এদের অবস্থানও এই মানচিত্রে অপ্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে। তাছাড়া, মানচিত্রে গাম্বিয়া নামে যে স্থানটিকে নির্দেশ করা হয়েছে সেখানে গাম্বিয়া নয়, রয়েছে গাজার অবস্থান।
প্রসঙ্গত, গেল কয়েক বছর ধরেই পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলের বিষয়ে নিয়মিত ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে আসছে রিউমর স্ক্যানার। দেখুন এখানে।
সুতরাং, সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোর ভুল উপস্থাপনের মাধ্যমে নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে প্রাচীন জেরিকো নগরী বিষয়ক একটি মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- BBC UK: Israel ‘poised to leave Jericho’
- Britannica: Walls of Jericho
- World Atlas: Maps Of Palestine
- Statement from Dr. Aksadul Alam
- Statement from Riham Abu Aita
- Statement from Abdullah Ibn Mahmud
- Rumor Scanner’s own investigation