ভুয়া ফটোকার্ড আর ভুল তথ্যে তিন পরিচিত মুখ যখন ক্যান্সার রোগী

ঘটনা গত ০৪ জুনের। চ্যানেল আইয়ের লোগো সম্বলিত একটি ফটোকার্ড পোস্ট করে সেদিন কণ্ঠশিল্পী ও সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বিষয়ে একটি তথ্য ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দেখে রিউমর স্ক্যানার৷ এসব পোস্টে দাবি করা হচ্ছিল, মমতাজ এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। রিউমর স্ক্যানার একাধিক ফেসবুক মনিটরিং টুল ব্যবহার করে Tanha নামে একটি ফেসবুক পেজে সেদিন দুপুর ১২ টা ২৬ মিনিটে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি খুঁজে পায় যার ক্যাপশনে লেখা ছিল, “আগামীতে সংসদে গান গাইবো কেডা।” উক্ত পোস্টে এ সংক্রান্ত দাবির বিষয়ে কোনো সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। 

আমরা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চ্যানেল আইয়ের ফেসবুক পেজে এ সংক্রান্ত কোনো ফটোকার্ড এবং দেশের কোনো গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো খবর না পেয়ে যোগাযোগ করি চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষের সাথে। তারা জানান, চ্যানেল আই মমতাজের বিষয়ে এমন কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি। এরপরই গণমাধ্যমটি তাদের ফেসবুক পেজে বিষয়টি ভুয়া বলে এক পোস্টেও নিশ্চিত করে। রিউমর স্ক্যানার অবশ্য তার পূর্বেই এ বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে। 

গণমাধ্যমগুলো তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা পেজ বা একাউন্টে নিউজের লিংক শেয়ারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা হিসেবে ফেসবুকে নিজেদের পেজে ফটোকার্ড নামে সংবাদ প্রচারের নতুন একটি উদ্যোগ বেছে নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই ফটোকার্ড নিয়েই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে দেশের গণমাধ্যমগুলোকে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় যে কেউ সহজেই ফটোকার্ড সম্পাদনা করে শিরোনাম এবং সংবাদ পুরোপুরি পাল্টে নিজের মনমতো বানিয়ে প্রচার করতে পারছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি যা হওয়ার হচ্ছে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমগুলোর। যা তারা প্রকাশ বা প্রচার করেনি তা-ই তাদের নাম, লোগো বা ধরণের আদলে বানিয়ে প্রচার করা হচ্ছে একই প্লাটফর্মে। বিব্রতকর এই পরিস্থিতির তেমনই এক শিকার হতে হলো চ্যানেল আইকে। মমতাজের বিষয়টি অবশ্য এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। ক্রমেই এই ফটোকার্ড প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। ‘সত্যের সন্ধানে’ নামে একটি পেজ থেকেই এই ফটোকার্ডে প্রায় লাখখানেক রিয়েক্ট পড়েছে। একই সময়ে প্রায় ৪৩০০ এর অধিকবার শেয়ার করা হয়েছে। 

Screenshot: Facebook 

যদিও রিউমর স্ক্যানারের এ সংক্রান্ত ফেসবুক ব্যানার পোস্ট করার পর ফটোকার্ড সম্বলিত পোস্টটি পেজ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই পেজটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ‘বাঁসের কেল্লা’ নাম নিয়ে পেজটি খোলা হয়। পরের বছর ‘বি. এন. পি. ও বাংলাদেশ’ এবং সর্বশেষ গত বছরের এপ্রিলে পেজটির নাম পাল্টে রাখা হয় ‘সত্যের সন্ধানে’। বাংলাদেশ থেকে দুইজন ব্যক্তি পেজটি পরিচালনা করছেন। 

মমতাজের বিষয় আলোচিত এই ফটোকার্ডের সম্ভাব্য সূত্রপাত Tanha নামের যে পেজটি, সেটি অবশ্য দেশে নয়, মালয়েশিয়া থেকে একজন পরিচালনা করছেন। এই পেজ পর্যবেক্ষণ করে আরও একাধিক গণমাধ্যমের বিকৃত বেশ কিছু ফটোকার্ড পোস্টের প্রমাণ পাওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই পেজ থেকেই ফটোকার্ডগুলোকে সম্পাদনা বা বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে। এই পেজটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর পেজটি চালুর পর এখন পর্যন্ত কয়েকবার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। শুরুতে ‘৭১’ চেতনা – Ekattor Catona’ নাম দেওয়া হলেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে নাম বদলে রাখা হয় ‘Binodon – বিনোদন’। পরবর্তীতে ২২ মার্চ বর্তমান নাম রাখা হয়।

আপনাদের আগেই জানিয়েছিলাম এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। এই ঘটনার দুইদিন না পেরোতেই গত ০৬ জুন অন্তত সকাল থেকে আলোচিত ব্লগার আসাদুজ্জামান নূর ওরফে আসাদ নূরের বিষয়েও প্রায় একই দাবি অর্থাৎ তিনিও ক্যান্সারে আক্রান্ত শীর্ষক একটি দাবি প্রচার পেতে শুরু করে। এবার এই দাবির সাথে জড়ানো হয় আরেক মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির নাম। গণমাধ্যমটির আদলে ফটোকার্ড তৈরি করে দাবিটিকে বিশ্বস্ততা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আসাদ নূর গেল কয়েক বছর ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আলোচনায় রয়েছেন। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করে আসছেন ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা৷ ২০১৭ সালের শেষ দিকে একই অভিযোগে তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন বলে জানা যায়। জনাব আসাদের এই অসুস্থতার দাবিটি তাই ভাইরাল হতে সময় নেয়নি। অসংখ্য পোস্ট আমরা দেখেছি, যাতে এই ফটোকার্ড শেয়ার করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’, “মহান আল্লাহতালা ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না…” ইত্যাদি শব্দ বা বাক্য ক্যাপশনে লেখা হয়েছে। 

Screenshot: Facebook

এ বিষয়ে আসাদ নূর নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত ৬ জুন রাত রাতে উক্ত দাবিকে মিথ্যা দাবি করে পোস্ট করেন। 

ক্যান্সার বিষয়ক এই দুই ফটোকার্ডের পর আরো একজন একই দাবির শিকার হয়েছেন, ইসলামি বক্তা ও হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। তার ক্ষেত্রে ফটোকার্ডকেই ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এতে কোনো গণমাধ্যমের নাম বা লোগো ব্যবহার করা হয়নি। 

Screenshot: Facebook 

ফেসবুকের একাধিক মনিটরিং টুল ব্যবহার করে মামুনুল হকের বিষয়ে এই দাবিটি কে বা কারা প্রথমদিকে প্রচার করেছে তা জানার চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার। অনুসন্ধানে আলোচ্য দাবিতে প্রচারিত সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি পাওয়া যায়। “মুক্ত চিন্তার স্বাধীন সৈনিক” নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত ৬ জুন দুপুর ৪ টা ৯ মিনিটে “মমতাজের এইডস রোগে আক্রান্ত হলেই দোষ” ক্যাপশনে উক্ত ফটোকার্ডটি প্রচার করতে দেখা যায়। যদিও এই দাবিটিরও কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। 

তিনটি ফটোকার্ডে ক্যান্সার নামের এক মরণব্যাধির সাথে পরিচিত তিন মুখকে জড়িয়ে ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়েছে। একইসাথে দুইটি গণমাধ্যমকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। 

প্রশ্ন হচ্ছে, ফটোকার্ডের মাধ্যমে ভুল তথ্য বা গুজব আপনার সামনে এলে তা আপনি শনাক্ত করবেন কীভাবে? ব্যাপারটা মোটেও কঠিন নয়। ফটোকার্ড সত্য নাকি ভুয়া তা শনাক্তের বেশকিছু কার্যকর উপায় আছে। 

বেশিরভাগ ফটোকার্ডে মিডিয়া হাউজের লোগোর পাশাপাশি তারিখও দেওয়া থাকে৷ সেই মিডিয়া হাউজের ফেসবুক পেজে গিয়ে “Photos” অপশন থেকে উক্ত দিনে প্রচারিত ফটোকার্ডগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যেতে পারে, প্রচারিত ফটোকার্ডটি সেখানে আছে কি না৷ অনেক সময় প্রচারিত ফটোকার্ডে ব্যবহৃত ছবিতে আসল ফটোকার্ড পাওয়া যায় কিন্তু শিরোনাম ভিন্ন থাকে। সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায়, আসল ফটোটির শিরোনাম বিকৃত করা হয়েছে। যদি প্রচারিত ফটোকার্ডটি মূল মিডিয়া হাউজের ফেসবুক পেজে পাওয়া যায়, তাহলে সত্য। (যদিও মিডিয়া হাউজের করা সংবাদের সত্যতা কতটুকু তা নিশ্চিত নয়, তবে প্রচার করা হয়েছে যে এটা সত্য)। পোস্টের এডিট হিস্টোরিও যাচাই করে দেখতে পারেন, পোস্টটি এডিট করা হয়েছে কিনা তা জানতে। 

এর বাইরে প্রচারিত ফটোকার্ডের লেখা কপি করে গুগলে সার্চ করে দেখতে পারেন। এতে করে উক্ত প্রচারিত দাবির স্বপক্ষে বা কাছাকাছি সংবাদ থাকলে সেটি পাওয়া যাবে। আবার এক্ষেত্রে কোন ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে সেটাও বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। যদি মূলধারার গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে খুঁজে পান তাহলে সেটি আসল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু যদি এমন কোনো ওয়েবসাইটে খুঁজে পান যা আপনার কাছে অপরিচিত কিংবা ডোমেইন নাম পেশাদার সংবাদমাধ্যমের নয়, সেক্ষেত্রে সংবাদটি খুঁজে পাওয়া গেলেও তা যে সত্য সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে না। 

যদি এই দুই উপায়েও খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে, ফটোকার্ডটি ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন উক্ত মিডিয়া হাউজের অন্যান্য ফটোকার্ডগুলোর ডিজাইন এবং ফন্টের মধ্যে মিল বা পার্থক্য লক্ষ্য করতে হবে। আসল এবং প্রচারিত ফটোকার্ডে একই অক্ষর থাকলে, দুটি অক্ষর হুবহু কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একইসাথে শ্যাডো বা রংয়ের পার্থক্যও দেখা যেতে পারে৷ এভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় ফটোকার্ডটি আসল নাকি নকল। 

তবে, প্রচারিত ফটোকার্ডে কোনো মিডিয়া হাউজের লোগো না থাকলে সেটি ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।  

ফটোকার্ডের লেখার বানানের বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। মূলত সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের ফটোকার্ডে প্রমিত বাংলা বানান ব্যবহার করে থাকে। যদি কোনো ফটোকার্ডের বানান গুরুতরভাবে অশুদ্ধ দেখা যায়, সেটি ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায়।

মিডিয়া হাউজের আসল ফটোকার্ড সম্পাদনা করে তৈরি ভুয়া ফটোকার্ডের শিকার হচ্ছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নানা ক্ষেত্রে জনপ্রিয়, আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তিবর্গ। খেলাধুলা বিষয়ক মিম পেজ, ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, মিম পেজ, শিটপোস্টিং হিসেবে পরিচিত পেজসহ নানা জায়গা থেকেই বিকৃত ফটোকার্ড ছড়াতে লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া, চলতি বছরের গত মে মাসে নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ১৩টি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এক মাসেই এত সংখ্যক ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে ভুল তথ্যের প্রচার গণমাধ্যমকে বিশ্বস্ততার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। 

আরও পড়ুন

spot_img