সম্প্রতি, “বিএনপি’র কোনো নেতার নাম মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় নাই, যারা গত দুই টার্ম সংসদের বিরোধীদল তারাই ভিসা নিষেধাজ্ঞায়” শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় বিএনপির কোনো নেতার নাম না থাকা ও গত দুই সংসদে যারা বিরোধীদল ছিল তারাই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। প্রকৃতপক্ষে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে কেবল ‘ক্ষমতাসীন ও রাজনৈতিক বিরোধী দল’ এমন বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার গণতন্ত্রের প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে বলে জানান।
দাবিটি নিয়ে অনুসন্ধানে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে গত ২৮ সেপ্টম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের বিস্তারিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
এই সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কাজে দায়ী কিংবা জড়িত থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সরকার এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসানীতি কার্যকর করার পদক্ষেপ আমরা শুরু করেছি।
আমরা ভিসানীতির কথা বলেছি তবে কারও নাম উল্লেখ করিনি। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল ও বাধাগ্রস্ত করার কাজে দায়ী কিংবা জড়িত যেকোনো বাংলাদেশির ক্ষেত্রে এই ভিসানীতি কার্যকর হবে। অন্য যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে যদি আমরা মনে করি তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে আমরা এই নীতি প্রয়োগ করব।’
পাশাপাশি বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওয়েবসাইটে গত ২২ সেপ্টেম্বর ‘Taking Steps to Impose Visa Restrictions on Individuals Involved in Undermining the Democratic Election Process in Bangladesh’ শীর্ষক শিরোনামে ম্যাথু মিলারের দেওয়া একটি প্রেস বিবৃতি খুঁজে পাওয়া যায়।
বিবৃতিটি থেকে জানা যায়, ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মাঝে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত আছেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই বিবৃতি বা ম্যাথু মিলারের সংবাদ সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণীতে আলোচিত দাবিটির সমর্থনে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং দেখা যায়, এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় ক্ষমতাসীন ও রাজনৈতিক বিরোধী দলসহ যেকোনো বাংলাদেশি পড়বেন। এ হিসেবে বিএনপির নেতারাও ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারেন।
মূলধারার গণমাধ্যম ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণে একইদিনে ‘ভিসা নীতির প্রয়োগ নিয়ে ডেইলি স্টারকে যা বললেন ডোনাল্ড লু’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু’র একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ভিসা নীতির আওতায় যাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে, তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না। কাউকে ভিসা না দেওয়াসহ যেকোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য।
পাশাপাশি ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া নিয়ে করা একটি প্রশ্নে লু বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষুণ্নকারীদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপক তথ্য এবং প্রতিটি তথ্য প্রমাণ ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই নীতির আওতায় কাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করে। আমরা এই প্রক্রিয়া সরকার, বিরোধী দল ও নিরাপত্তা সংস্থার ওপর সমান ও যথাযথভাবে প্রয়োগ করি।’
অর্থাৎ, ডোনাল্ড লুও তার সাক্ষাতকারে কোনো সুনির্দিষ্ট দলের বিষয় উল্লেখ করেননি।
মুলত, সম্প্রতি বিএনপির কোনো নেতার নাম মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় নাই, যারা গত দুই টার্ম সংসদের বিরোধীদল তারাই ভিসা নিষেধাজ্ঞায়- শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে উক্ত দাবির পক্ষে কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে দেখা যায়, গত ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঐ ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। এছাড়া গত ২৮ সেপ্টেম্বর আরেক সংবাদ সম্মেলনে মিলার জানান, যেকোনো বাংলাদেশি এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারেন।
উল্লেখ্য, পূর্বেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মার্কিন ভিসা বাতিলের গুজব ছড়িয়ে পড়লে সেসময় বিষয়গুলো নিয়ে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এমন কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন–
- সিইসি নুরুল হুদার মার্কিন ভিসা বাতিলের তথ্যটি গুজব
- আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মার্কিন ভিসা বাতিলের দাবিটি মিথ্যা
- প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আমেরিকার ভিসা বাতিলের দাবিটি গুজব
- সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধিদের মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা বাতিলের গুজব
সুতরাং,মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞায় বিএনপির কোনো নেতার নাম না থাকা ও গত দুই সংসদে যারা বিরোধীদল ছিল তারাই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- US Embassy BD: Press Release
- The Daily Star: ভিসা নীতির প্রয়োগ নিয়ে ডেইলি স্টারকে যা বললেন ডোনাল্ড ল
- Jugantor- যে কারণে ভিসা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করে না যুক্তরাষ্ট্র
- Rumor Scanner’s Own Analysis