গত ১৪ আগস্ট জামায়াত নেতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যাওয়ার পর পরদিন তার জানাজার নামাজে অংশগ্রহণে জনস্রোতের দৃশ্য দাবিতে ফ্লাইওভারের নিচ থেকে ধারণকৃত একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকের একাধিক পোস্টে উক্ত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওটি সাঈদীর জানাজায় অংশগ্রহণে জনস্রোতের দৃশ্য শীর্ষক যে দাবিটি করা হচ্ছে তা সঠিক নয় বরং ভিডিওটি গত জুন থেকেই ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ সাঈদীর মৃত্যু হয়েছে গত ১৪ আগস্ট। তাই ভিডিওটি সাঈদীর জানাজা কেন্দ্রিক হওয়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ফেসবুকে চলতি বছরের জুনে একই ভিডিও (আর্কাইভ) খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
১১ জুন প্রকাশিত এই ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয়, এটি জামায়াতে ইসলামীর মিছিলের ভিডিও।

কিন্তু ভিডিওটি গত জুন মাসের ধারণকৃত বলে প্রতীয়মান হয়নি আমাদের কাছে। এর পেছনে দুইটি কারণ পেয়েছি আমরা।
প্রথমত, গত ১০ জুন দীর্ঘদিন পর জামায়াতে ইসলামী ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি পায়। সেদিন রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এই সমাবেশের আয়োজন করে দলটি। কিন্তু সেদিন দলটির কর্মী ও সমর্থকদের সমাবেশে যোগ দেওয়ার একাধিক ভিডিও বিশ্লেষণ করেও আলোচিত ভিডিওটির সাথে মিল পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়ত, ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মুসল্লিদের পরনে শীতের পোশাক রয়েছে। বাংলাদেশে জুনে গ্রীষ্মকাল (বাংলা জৈষ্ঠ্যমাস) থাকায় সেসময় শীতের পোশাক পরে না সাধারণত কেউ।

অর্থাৎ, ভিডিওটি গত জুনের নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে রিউমর স্ক্যানার টিমের কাছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ২০১৮ সালের ০৭ ডিসেম্বর মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজি নামক একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মুসু্ল্লিদের মিছিলের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। মিছিলটি ঢাকার যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় ভিডিওটি ধারণ করা হয়। সেসময় শীতকাল হওয়ায় এই ভিডিওতে অনেককেই শীতের পোশাক পরা অবস্থায় দেখেছি আমরা।

জনাব রাজির সেদিন করা অন্য পোস্টেও ফ্লাইওভারের নিচে মুসুল্লিদের জমায়েত লক্ষ্য করা গেছে।

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র সেদিনের এক ভিডিও প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “বিশ্ব ইজতেমায় আধিপত্য নিয়ে গত ০১ ডিসেম্বর টঙ্গিতে তাবলিগ জামাতের দুপক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে একজন নিহত হন। সেই ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোড়ে সমাবেশ ও মিছিল করেছে মাওলানা সাদ কান্ধলভী-বিরোধী অংশ। প্রথম আলোর ভিডিওতে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে মুসুল্লিদের ভীড় দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

তবে আমরা যে ভিডিওটির বিষয়ে অনুসন্ধান করছি সেটি একই ঘটনার বা সেদিনেরই কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ভিডিও বিশ্লেষণে সেদিনের ঘটনারই বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে এটা নিশ্চিত যে, ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ে সাঈদীর জানাজা অভিমুখে জনস্রোতের নয়।
মূলত, গত ১৪ আগস্ট জামায়াত নেতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। পরদিন তার জানাজার নামাজ অভিমুখে জনস্রোতের দৃশ্য দাবিতে ফ্লাইওভারের নিচ থেকে ধারণকৃত একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়। একই ভিডিও গত জুন থেকেই ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, পূর্বেও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজার দৃশ্য দাবিতে কিছু ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হলেও সে বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামীর হয়ে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। পরে ২ আগস্ট এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর থেকেই কারাগারে ছিলেন জামায়াতের এই নেতা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মোট বিশটি অভিযোগের মধ্যে আটটিতে তিনি আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দুটো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আদালত ২০১৩ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়। তবে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ২০১৪ সালে আপীল বিভাগ সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও সাঈদীর পৃথক রিভিউ আবেদন খারিজ করে ২০১৭ সালের ১৫ মে আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। এরপর থেকে কারাগারে থেকেই সাজা ভোগ করছিলেন তিনি। গত ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
সুতরাং, পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিওকে সাঈদীর জানাজা অভিমুখে জনস্রোতের দৃশ্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- মুক্ত কণ্ঠ: Facebook Video
- Prothom Alo: বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদ বিরোধীদের সমাবেশ
- Rumor Scanner’s own analysis