তুর্কির চ্যানেলে ৫ বছরের বাচ্চার অলৌকিক ঘটনা নিয়ে সাক্ষাতকারের গল্পটি গুজব

তুরস্কে গত ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের ঘটনায় এক শিশুর ছবি ব্যবহার করে শিশুটি ১১২ ঘন্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হয়ে অলৌকিক এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছে শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

কী দাবি করা হচ্ছে?

ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে বিধ্বস্ত কোনো স্থাপনা বা ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে উদ্ধারকৃত এক শিশুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, “তুর্কির একটি চ্যানেল ৫ বছরের এক বাচ্চার সাথে কথা বলে যাকে, ১১২ ঘন্টা পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তুমি কি এত দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকনি? সে উত্তরে বলে একজন সাদা পোশাকের ব্যক্তি তার নিকট এসে তাকে খাবার ও পানি দিত, অতপর চলে যেত।”

Screenshot source: Facebook

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

Screenshot source: CrowdTangle

উক্ত শিশুর ছবি ছাড়াও একই তথ্যগুলো স্ট্যাটাস আকারেও পোস্ট হয়েছে ফেসবুকে।

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।

Screenshot source: Facebook

একই দাবিতে ইউটিউবের একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot source: Youtube

একই দাবিতে টিকটকের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ভিডিওগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

Screenshot source: TikTok

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ঘটনায় এক শিশুর ছবি ব্যবহার করে যে তথ্যগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে তা সঠিক নয় বরং একটি টুইটার পোস্টকে সূত্র ধরে উক্ত দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং পরবর্তীতে সেই টুইটটিও ডিলিট করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, শিশুর ছবিটিও দুই বছরের বেশি সময়ের পুরোনো।  

গত ০৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় বিধ্বংসী এক ভূমিকম্পে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে।  তুরস্কের সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্পের ঘটনায় ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে তুরস্কের একটি চ্যানেলকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে পাঁচ বছরের এক শিশু ১১২ ঘন্টা পর উদ্ধার হওয়ার পর অলৌকিক এক ঘটনার বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কিওয়ার্ড সার্চ করে ফেসবুকে একটি টুইটার অ্যাকাউন্টের টুইটের স্ক্রিনশট অসংখ্য মানুষকে শেয়ার করতে দেখেছি আমরা।

Facebook Screenshot collage: Rumor Scanner

‘Saad Türkmen’ নামক উক্ত টুইটার অ্যাকাউন্টে গত ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আরবি ভাষায় লেখা টুইটটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “কিছুক্ষণ আগে ‘A Haber’ নামক তুর্কি চ্যানেল একজন ৫ বছর বয়সী ছেলের সাথে দেখা করেছে যে ১১২ ঘন্টা পরে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হয়েছে। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল: তুমি কি এত ঘন্টা ক্ষুধার্ত ছিলে না? সে বলেছে, একবার সাদা পোশাক পরা একজন ব্যক্তি আমার কাছে আসতেন এবং আমাকে খাওয়াতেন এবং আমাকে পানি দিতেন এবং তারপর যেতেন!! আমি হলফ করে বলছি এটাই ছিল শিশুটির উত্তর!”

Screenshot source: Twitter

অনুসন্ধানে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা টুইটারে আলোচিত টুইটটি খুঁজে পাই। 

জনাব সাদ ‘A Haber’ নামক একটি চ্যানেলে ‘কিছুক্ষণ আগে’, অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি (যেদিন টুইট করেছিলেন) আলোচিত ঘটনাটি দেখেছেন বলে টুইটে উল্লেখ করেছেন। 

তাছাড়া, তিনি ১১২ ঘন্টা পর শিশুটি উদ্ধার হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তুরস্কে ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর চারটার কিছু পরে ভূমিকম্প হওয়ায় ১১২ ঘন্টা হওয়ার কথা ১১ ফেব্রুয়ারি। 

এই তথ্যগুলোর সূত্র ধরে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম ‘A Haber’ -এর ওয়েবসাইট সহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ভিডিও এবং প্রতিবেদনগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন কোনো ঘটনার বিষয়ে আমরা জানতে পারিনি।  

পরবর্তীতে ‘A Haber’ কর্তৃপক্ষের সাথে একাধিক মাধ্যমে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহী হননি।

‘A Haber’ ছাড়াও তুরস্কের অন্যান্য সংবাদমাধ্যম এবং আন্তজার্তিক একাধিক গণমাধ্যমে আমরা এই ঘটনার বিষয়ে জানতে ম্যানুয়াল এবং কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখেছি। কিন্তু এক শিশুর সাথে এই ধরনের ঘটনা ঘটার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোতে কোনো তথ্য পাইনি। 

এই অনুসন্ধান চলাকালীন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি উক্ত টুইট লিংকে ক্লিক করে আমরা টুইটটি খুঁজে পাইনি। অর্থাৎ, টুইটটি ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। 

Screenshot source: Twitter

রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে তুরস্কের একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের সাথেও যোগাযোগ করা হয়। তাদের পক্ষ থেকে রিউমর স্ক্যানারকে বলা হয়, তারা এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে অবগত নন। 

অর্থাৎ, উক্ত টুইটকে কেন্দ্র করে ছড়ানো তথ্যগুলো ভিত্তিহীন। তাছাড়া, আলোচিত টুইটটিও ডিলিট করে দেওয়ায় উক্ত তথ্যগুলো গুজব বলেই প্রতীয়মান হয়।

কিন্তু ছবিটি?

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে একটি ছবিও যুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছিলাম আমরা। এ বিষয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘CBS NEWS’ এর ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ০৩ নভেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot source: CBS NEWS

ছবিটির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, তুরস্কের ইজমিরের ভূমিকম্পের চারদিন পর বিধ্বস্ত একটি ভবন থেকে তিন বছরের আয়দা গেযজিন নামক এক শিশুকে উদ্ধার করা হয় ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর। 

অর্থাৎ, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা দাবিতে ছড়িয়ে পড়া আলোচিত তথ্যগুলোর সাথে একটি শিশুর যে ছবি যুক্ত করা হয়েছে তা দুই বছরেরও বেশি সময়ের পুরনো।

আলোচিত শিশুর এই ছবি ব্যবহার করে তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ঘটনায় ভিন্ন আরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। পড়ুন এখানে।  

মূলত, গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের ঘটনায় ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে তুরস্কের ‘A Haber’ চ্যানেলকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে পাঁচ বছরের এক শিশু ১১২ ঘন্টা পর উদ্ধার হওয়ার পর অলৌকিক এক ঘটনার বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর সূত্রপাত হিসেবে উল্লিখিত আলোচিত টুইটটি পরবর্তীতে ডিলিট করে দেওয়া হয়। উক্ত চ্যানেলেও এমন কোনো ঘটনার বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, উক্ত তথ্যগুলোর সাথে যে শিশুর ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটিও দুই বছরের বেশি সময়ের পুরোনো। সার্বিক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষে এই ঘটনাটি ভিত্তিহীন হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।  

সুতরাং, তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ঘটনার একটি চ্যানেলকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে পাঁচ বছরের এক শিশু ১১২ ঘন্টা পর উদ্ধার হওয়ার পর অলৌকিক এক ঘটনার বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন বলে ইন্টারনেটে দাবি করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img