নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন নরেন্দ্র মোদি শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর 

সম্প্রতি, “শান্তিতে নোবেল পেতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।” শীর্ষক একটি তথ্য বাংলাদেশ ও ভারতের একাধিক গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 

কী দাবি করা হচ্ছে?  

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কালের কণ্ঠ লিখেছে, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন তথ্য গত ১৬ মার্চ নরওয়ের নোবেল পুরস্কার কমিটির এক প্রতিনিধিদলের ইঙ্গিতে জানা গেছে। 

মানবজমিনের প্রতিবেদনে এসেছে, প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্বে থাকা নরওয়ে নোবেল প্রাইজ কমিটির উপ-প্রধান অ্যাসলে তোজে-ই মেদি নোবেল পেতে পারেন বলে আলোচিত মন্তব্যটি করেন। 

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন কালের কণ্ঠ, রাইজিং বিডি, বাংলাদেশ জার্নাল, মানবজমিন, আমাদের সময়, সোনালী নিউজ, ঢাকা মেইল। 

Screenshot source: MZamin

কালের কণ্ঠ পত্রিকার ১৭ মার্চের প্রিন্ট সংস্করণেও উক্ত খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। দেখুন এখানে। 

Screenshot source: Kaler Kantho 

একই দাবিতে কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot source: Facebook 

ভারতীয় গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন আনন্দবাজার পত্রিকা, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, এবিপি লাইভ

Screenshot source: Ananda Bazar

একই দাবিতে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot source: YouTube

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শান্তিতে নোবেল পেতে পারেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি নোবেল কমিটির ডেপুটি লিডার অ্যাসলে তোজে বরং নোবেল পুরস্কার বিষয়ক তার একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে উক্ত দাবিটি ছড়িয়ে পড়েছে। 

রিউমর স্ক্যানার টিম অ্যাসলে তোজের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, অ্যাসলে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে থাকা নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির ডেপুটি লিডার। 

গত ১৪ মার্চ তোজে ভারতের নয়াদিল্লীতে শান্তি এবং বিকল্প উন্নয়নের মডেল বিষয়ে এক গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দেন তিনি। এই আয়োজনে তোজে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বশান্তির সম্ভাবনা বিষয়ে বক্তব্য দেন। এরপর ভারতের একাধিক মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত গোলটেবিল বৈঠকের পুরো ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

কিন্তু ভিডিও পর্যবেক্ষণে তোজে কর্তৃক ‘নরেন্দ্র মোদির নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন’ শীর্ষক কোনো মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ভারতের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ‘Boom’ গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোর কমিটির সদস্য মনোজ কুমার শর্মার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। জনাব মনোজ জানিয়েছেন, “নরওয়ের নোবেল কমিটির উপ-নেতার সঙ্গে আমি সবসময় ছিলাম—বক্তৃতার সময় তো বটেই, এমনকী আইটিসি মৌর্য শেরাটন হোটেলেও, যেখানে তাঁর সাক্ষাত্কার নিতে আসেন টাইমস নাউ-এর সাংবাদিক l কী ১৪ মার্চ তাঁর বক্তৃতায়, কী গতকাল তাঁর সাক্ষাৎকারে অ্যাসলে টোজে কখনওই মোদির নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বলেননি।”

পরবর্তীতে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোকে দেওয়া তোজের স্বাক্ষাৎকারগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছি আমরা। 

অ্যাসলে তোজে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘The New Indian’ কে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমি আশা করি, সব নেতাই এই পুরস্কার পাওয়ার মতো প্রয়াস চালাতে অনুপ্রাণিত বোধ করবেন।

Screenshot source: YouTube

তোজে ভারতের আরেক সংবাদমাধ্যম ABP NEWS এর সাথেও কথা বলেছে। সংবাদমাধ্যমটির সাংবাদিক তোজের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মেদি তার নেতৃত্বের মাধ্যমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে সক্ষম কিনা। এর উত্তরে তোজে বলছিলেন, “আপনি জিজ্ঞাসা করছেন তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রার্থী কিনা? আমার প্রত্যেকের জন্য একই উত্তর, আমি আশা করি প্রতিটি জাতির প্রতিটি নেতা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাজটি করতে অনুপ্রাণিত হবেন। আমি মেদির জন্য এটি আশা করি। স্পষ্টতই, আমি তার প্রচেষ্টা অনুসরণ করছি; আমরা সবাই-ই করি। আমি সত্যিই আশা করি যে তার উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হবে।”

Screenshot source: YouTube

কোর কমিটির সদস্য মনোজ কুমার শর্মা বলছিলেন যে অ্যাসলে তোজে টাইমস নাউ-এর সাংবাদিকের সাথেও কথা বলেছিল। আমরা তাই সে বিষয়েও অনুসন্ধান করেছি। 

টাইমস নাউ তোজের সাক্ষাৎকারের একটি ভিডিও গত ১৬ মার্চ সংবাদমাধ্যমটির টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করে। ভিডিওটির ক্যাপশন বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী মেদি নোবেল শান্তি পুরস্কারের বৃহত্তম দাবিদার, বলছেন নোবেল পুরস্কার কমিটির উপ-নেতা অ্যাসলে তোজে!” তবে পরবর্তীতে টুইটটি ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। আর্কাইভ টুইটটি দেখুন এখানে।

Screenshot source: Twitter

টাইমস নাউ-এর প্রধান সম্পাদক রাহুল শিবশংকরও তার ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্টে একই দাবিতে টুইট করেন, যা পরে তিনিও ডিলিট করেন। টুইটটির আর্কাইভ দেখুন এখানে।

Screenshot source: Twitter 

অর্থাৎ, নোবেল প্রাইজ কমিটির উপ-প্রধান অ্যাসলে তোজে-ই মেদি নোবেল পেতে পারেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি। 

অ্যাসলে তোজে কি এ ধরনের কোনো মন্তব্য করার এখতিয়ার রাখেন? 

নোবেল ফাউন্ডেশনের বিধি অনুযায়ী নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন সম্পর্কিত কোনো তথ্য জনসম্মুখে বা ব্যক্তিগতভাবে ৫০ বছরের আগে কখনো প্রকাশ করা হয় না। এ বিধির আওতায় পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তি, মনোনয়ন বাছাইকারী ও মনোনয়নকারী, পাশাপাশি এ পুরস্কার সম্পর্কিত তদন্ত এবং মতামত সবই অন্তর্ভুক্ত। 

Screenshot source: Noble Prize 

এ বিধিতে বলা হয়েছে, নোবেল কমিটি গণমাধ্যম বা প্রার্থীদের কাছে কখনোই তাদের নাম প্রকাশ করে না। প্রদত্ত পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে এ নিয়ে আগাম জল্পনা-কল্পনা করা হয়। এটি করা হয় নিছক অনুমান থেকে অথবা মনোনয়নের পিছনে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে। 

নোবেল শান্তি পুরস্কার নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। যেটি শুরু হয় মূলত প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। এই সময় নরওয়ের নোবেল কমিটি অনুমোদিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে মনোনয়ন চায়। যা পহেলা ফেব্রুয়ারির আগে নরওয়ের অসলোতে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিতে পাঠানো হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মনোনয়নের জন্য পাঠানো ব্যক্তিদের মধ্য থেকে প্রার্থীদের কাজের মূল্যায়ন করে এবং একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করে। তারপর মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত তালিকার উপর উপদেষ্টা পর্যায়ে পর্যালোচনা হয় এবং অক্টোবরে এসে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের বেছে নেওয়া হয়। এই মাসের শুরুতে, নোবেল কমিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের নির্বাচন করে। এরপর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় এবং বিজয়ীদের হাতে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ নরওয়ের অসলোতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

তবে, এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কখনোই নোবেল কর্তৃপক্ষ মনোনীত প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করে না।

অর্থাৎ, মেদি নোবেল পেতে পারেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য অ্যাসলে তোজে কর্তৃক করার কথা নয় কারণ মনোনীত প্রার্থীদের নাম পুরস্কার প্রদানের পূর্বে কখনো প্রকাশ করা হয় না।

মূলত, গত ১৪ মার্চ ভারতে এক গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দেন নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির ডেপুটি লিডার অ্যাসলে তোজে। পরবর্তীতে একাধিক সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলেন তিনি। এরপরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন বলে জানান তোজে শীর্ষক একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, তোজে কোনো সংবাদমাধ্যমকেই এমন কিছু বলেননি। নোবেল পুরস্কার বিষয়ক তার একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে উক্ত দাবিটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। 

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে “নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের ডা. রায়ান সাদী” শীর্ষক একটি তথ্য দেশীয় গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল রিউমর স্ক্যানার৷ 

সুতরাং, নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির ডেপুটি লিডার অ্যাসলে তোজে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শীর্ষক মন্তব্য করেছেন বলে একটি দাবি ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

  • ABP NEWS: YouTube
  • TIMES NOW: Tweet
  • Rumor Scanner’s own analysis

আরও পড়ুন

spot_img