সম্প্রতি, +৯২ এবং +৯৯ দিয়ে শুরু হওয়া নম্বর থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হয়ে যাবে দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন কালবেলা (ইউটিউব) এবং একাত্তর টিভি (ইউটিউব)।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে টিকটকে প্রচারিত কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, +৯২ এবং +৯৯ দিয়ে শুরু হওয়া নম্বর থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হয়ে যাওয়ার দাবিটি সত্য নয় বরং এ প্রক্রিয়ায় ফোন হ্যাক হওয়া অসম্ভব।
বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৮ এপ্রিল একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার ফেসবুক পেজে প্রচারিত একটি ভিডিওতে (আর্কাইভ) দাবি করেন, +৯২ এবং +৯৯ দিয়ে শুরু নম্বর থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হয়ে যাবে।
Screenshot Source: Facebook.
অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত পুলিশ কর্মকর্তার নাম জাহাঙ্গীর আলম। তিনি টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই)। ২৭ লক্ষ ফলোয়ারের ফেসবুক পেজ থেকে প্রায়ই সচেতনতা মূলক ভিডিও প্রচার করেন তিনি। উক্ত পেজেই কল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হওয়া সংক্রান্ত উক্ত ভিডিওটি প্রচার করেছিলেন তিনি। যা পরবর্তীতে একাধিক গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়।
তবে গত ১৩ এপ্রিল একটি নতুন ভিডিওতে (আর্কাইভ) জাহাঙ্গীর আলম তার আগের ভিডিওতে দেওয়া ভুল তথ্য সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, শুধু ফোনকল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হওয়া সম্পর্কিত তার পূর্ববর্তী ভিডিওতে দেওয়া তথ্যটি ভুল ছিল। এই ভুলের কারণে তিনি তার পূর্ববর্তী ভিডিওটি অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এই সিদ্ধান্তের কথা নতুন ভিডিওতে জানান।
নম্বরের শুরুতে থাকা +৯২ এবং +৯৯ সংখ্যাগুলো কি?
ফোন নম্বরের শুরুতে যোগ চিহ্ন (+) এর পরে থাকা সংখ্যাগুলো আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড বা কান্ট্রি কোড নামে পরিচিত। প্রতিটি দেশের নিজস্ব একটি কান্ট্রি কোড থাকে। যেমন, বাংলাদেশের কান্ট্রি কোড হলো ৮৮০। ৯২ হলো পাকিস্তানের কান্ট্রি কোড। অন্যদিকে, ৯৯ হলো বেশ কিছু দেশের কান্ট্রি কোডের প্রথমাংশ, যেমন— ৯৯২ তাজিকিস্তানের কান্ট্রি কোড, ৯৯৩ তুর্কমেনিস্তানের কান্ট্রি কোড, এবং ৯৯৪ আজারবাইজানের কান্ট্রি কোড।
কেবল ফোন রিসিভের মাধ্যমে কি হ্যাক সম্ভব?
অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার এভিজি (AVG) এর ওয়েবসাইটে ফোন হ্যাকিং সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সাধারণ কলের মাধ্যমে ফোন হ্যাক হওয়া সম্ভব নয়।
সাইবার সিকিউরিটি সফটওয়্যার কোম্পানি অ্যাভাস্টের ওয়েবসাইটে ফোন হ্যাকিং সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্তরে জানানো হয়েছে, ফোনকল সরাসরি ফোন হ্যাকের উৎস হতে পারে না। কিন্তু ফোনকল ফিশিং আক্রমণ বা অন্যান্য প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
অ্যাভাস্টের ভিন্ন একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ফোনকলের মাধ্যমে সরাসরি হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়া অসম্ভব। তবে ফোন কলের মাধ্যমে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাটাক করা হতে পারে।
সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি ক্যাসপারেস্কির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো এক ধরনের প্রতারণা কৌশল যা মানুষের ভুলকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য প্রাপ্তি, অ্যাক্সেস লাভ, অথবা মূল্যবান সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
অর্থাৎ, কেবল ফোনকল রিসিভের মাধ্যমে ফোন হ্যাক হওয়া অসম্ভব। তবে কলের মাধ্যমে প্রতারক ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রতারণা করতে পারে।
পরবর্তীতে এসব কলের নেপথ্য জানতে অনুসন্ধানের মাধ্যমে গত ১ এপ্রিল মূলধারার সংবাদমাধ্যম ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি নতুন ধরনের ডিজিটাল প্রতারণা ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রতারণায় ব্যক্তিদেরকে ইংরেজিতে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে ফোন কল করা হয়। এই ফোনকলগুলো প্রায়শই বিদেশি নম্বর থেকে আসে এবং ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল (VoIP) ব্যবহার করে করা হয়। চক্রগুলো সাধারণত প্রথমে অল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে। তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে অতিরিক্ত সুদসহ অর্থ ফেরত দেবে, বড় অঙ্ক পাঠালে বেশি সুদ পাওয়া যাবে—এমন প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয় চক্রগুলো।
গেলো বছরের দৈব চয়ন ভিত্তিতে নভেম্বরে একই বিষয় নিয়ে একটি কেস স্টাডি প্রকাশ করেছিল রিউমর স্ক্যানার টিম। রিউমর স্ক্যানারের সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দৈবচয়নভিত্তিতে কোনো ব্যক্তিকে মুঠোফোনে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয়ের সুযোগের কথা জানিয়ে খুদে বার্তা বা ফোনকল দেওয়া হয়৷ কেউ যদি তাতে সাড়া দেয়, তাকে কিছু টাস্ক দেওয়া হয়। টাস্ক সম্পন্ন হওয়া সাপেক্ষে প্রথমদিকে কিছু অর্থ প্রদান করা হলেও পরবর্তীতে বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করা হয় ভুক্তভোগীকে। সে ফাঁদে পা দিয়ে অর্থ খুইয়ে প্রতারিত হওয়ার প্রমাণও পেয়েছিল রিউমর স্ক্যানার টিম।
মূলত, +৯২ এবং +৯৯ দিয়ে শুরু হওয়া নম্বর থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হয়ে যাবে দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবিটি মিথ্যা। আসলে, ফোন নম্বরের শুরুতে থাকা ‘+’ চিহ্নের পরের সংখ্যাগুলো হলো কান্ট্রি কোড। ৯২ হলো পাকিস্তানের কান্ট্রি কোড এবং ৯৯ হলো বেশ কিছু দেশের কান্ট্রি কোডের প্রথমাংশ। তাছাড়া কেবল একটি ফোন কল রিসিভের মাধ্যমে ফোন হ্যাক হওয়া সম্ভব নয়। তবে প্রতারকরা কলের সাহায্যে ভিক্টিমের ব্যক্তিগত তথ্য প্রতারণার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করতে পারে।
সুতরাং, +৯২ এবং +৯৯ দিয়ে শুরু হওয়া নম্বর থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করলেই ফোন হ্যাক হয়ে যাওয়ার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s own analysis.
- Jahangir Alam on Facebook – https://www.facebook.com/sijahangiralam81/videos/794824892565200
- Wikipedia – List of country calling codes
- AVG – Signs Your Phone Has Been Hacked
- Avast – Can Someone Hack Your Phone by Calling or Texting You?
- Avast –How to Know If Your Phone Has Been Hacked
- Kaspersky – What is Social Engineering?
- Daily Star Bangla – ফোন করে ইংরেজিতে চাকরির অফার, প্রতারণার নতুন রূপ