ভিন্ন ওয়েবসাইটের মন্তব্যকে প্রথম আলোতে আইএমএফের মন্তব্য দাবিতে প্রচার

সম্প্রতি, “সংকটের সীমানায় অর্থনীতি: আইএমএফ” শীর্ষক শিরোনামে জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

কী দাবি করা হচ্ছে?

প্রথম আলো’য় গত ১৫ জানুয়ারী প্রকাশিত প্রতিবেদনে (আর্কাইভ) বলা হয়েছে, “বাণিজ্য-ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ ও মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সংকটের সীমানায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অথচ বৈশ্বিক মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিই ছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বা ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহর ঢাকা সফর উপলক্ষে আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ অংশে গতকাল শনিবার এসব কথা বলা হয়েছে। আইএমএফের ডিএমডি গতকাল দুপুরে বাংলাদেশে এসেছেন। পাঁচ দিনের সফর শেষ করে ১৮ জানুয়ারি ঢাকা ছাড়বেন তিনি।”

অর্থাৎ, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ওপরের তথ্যগুলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল “আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ অংশে” প্রকাশিত হয়েছে।

একই দাবিতে অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন দৈনিক দিনকাল, আমাদের অর্থনীতি। 

একই দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আইএমএফের বিষয়ে প্রথম আলোয় প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক নয় বরং ভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্যকে প্রথম আলোয় আইএমএফের বক্তব্য হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।

অনুসন্ধান যেভাবে

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল “আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ অংশে” প্রকাশিত তথ্যগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে আইএমএফের ওয়েবসাইটে ‘Foreign Brief’ নামে কোনো সেকশন খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

পরবর্তীতে উক্ত ওয়েবসাইটের ‘Bangladesh’ সেকশনে বাংলাদেশ বিষয়ক আইএমএফ কর্তৃক প্রকাশিত সকল ডকুমেন্ট খুঁজে পাওয়া যায়। ডকুমেন্টগুলোর মধ্যে চলতি বছর (২০২৩) শুধু একটি ডকুমেন্ট প্রকাশিত হয়েছে।

গত ১৬ জানুয়ারী “Press Statement by International Monetary Fund Deputy Managing Director Antoinette M. Sayeh” শিরোনামে উক্ত ওয়েবসাইটে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot source: IMF

তবে প্রথম আলো’র প্রতিবেদনটি ১৫ জানুয়ারী প্রকাশ হওয়ায় ১৬ জানুয়ারী প্রকাশিত উক্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি থেকে পত্রিকাটির তথ্য নেওয়ার সুযোগ নেই। 

ফরেন ব্রিফের খোঁজে

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লিখিত “আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ নামক সূত্রের খোঁজে কিওয়ার্ড সার্চ করে foreignbrief.com নামে একটি ওয়েবসাইটে গত ১৪ জানুয়ারী “IMF Official visits Bangladesh” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটিতে আইএমএফ সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার বরাতে কোনো তথ্য উল্লেখ না করে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বা ডিএমডি অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহর ঢাকা সফরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। 

এই প্রতিবেদনের একটি অংশে লেখা রয়েছে, “The Bangladesh economy was one of the fastest growing in the world before the pandemic and subsequent global economic downturn. Now, its economy is bordering on crisis as trade deficits, rising fuel costs, growing inflation, and shrinking foreign currency reserves.”

অন্যদিকে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের প্রথম প্যারায় লেখা রয়েছে, “বাণিজ্য-ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ ও মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সংকটের সীমানায় রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অথচ বৈশ্বিক মহামারি এবং মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তার আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিই ছিল।”

প্রথম আলোর প্রতিবেদনের এই অংশের সাথে ফরেন ব্রিফের উল্লিখিত অংশটি মিলে যায়।

Image illustration: Rumor Scanner 

ফরেন ব্রিফের প্রতিবেদনের উল্লিখিত অংশটি প্রতিষ্ঠানটি আইএমএফের বরাতে উল্লেখ করেছে এমন কোনো তথ্য প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়নি। 

তাছাড়া, ফরেন ব্রিফ ওয়েবসাইট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওয়েবসাইটটি মূলত ‘Foreign Brief Pty Ltd’ নামের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের। ২০১৫ সালে চালু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি ভূ-রাজনৈতিক তথ্যের একটি ওপেন সোর্স উৎস হিসেবে কাজ করে এবং প্রতিষ্ঠানটি মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেই বেশী মনোযোগী। 

Screenshot source: Foreign Brief

ফরেন ব্রিফের পুরো ওয়েবসাইটটি যাচাই করে প্রতিষ্ঠানটির সাথে আইএমএফের কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম। 

তাছাড়া, আইএমএফের ওয়েবসাইটে কিওয়ার্ড সার্চ করেও ফরেন ব্রিফের সাথে সংস্থাটির সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য মেলেনি। 

Screenshot source: IMF

অর্থাৎ, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আইএমএফের বরাতে যে বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে সে বক্তব্য আইএমএফ দেয়নি। বরং প্রথম আলো ফরেন ব্রিফ নামে একটি ওয়েবসাইটের বক্তব্যকে আইএমএফের বক্তব্য নামে প্রচার করছে।

মূলত, গত ১৪ জানুয়ারী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহর ঢাকা সফরে আসেন। এ বিষয়ে ‘প্রথম আলো’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ নামক একটি সূত্রকে উল্লেখ করে “আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটের সীমানায় রয়েছে দাবি করেছে” শীর্ষক একটি মন্তব্য প্রচার করা হয়। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, আইএমএফের ‘ফরেন ব্রিফ’ নামক কোনো সেকশন নেই। বরং, প্রথম আলো ‘ফরেন ব্রিফ’ নামে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ওয়েবসাইটের বক্তব্যকে আইএমএফের বক্তব্য হিসেবে প্রচার করছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের নভেম্বরে আইএমএফের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রকৃত ‍রিজার্ভ ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেছে শীর্ষক গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, ভিন্ন একটি ওয়েবসাইটের তথ্যকে প্রথম আলোয় আইএমএফের বক্তব্য হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img