আইএমএফের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রকৃত ‍রিজার্ভ ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি “আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রকৃত ‍রিজার্ভ পাওয়া গেছে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আছে ৫.৬ বিলিয়ন ডলার আর ফেডারেল রিজার্ভে ৮ বিলিয়ন।” শীর্ষক শিরোনামের একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আইএমএফের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রকৃত ‍রিজার্ভ ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয় বরং আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলার। 

কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতির মাধ্যমে ‘বিবিসি নিউজ বাংলা’ এর ওয়েবসাইটে গত ১৩ নভেম্বর “বাংলাদেশের ২৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অর্থনীতির জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, “আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, যেভাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ হিসাব করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। তারা যেভাবে হিসাব করতে বলেছে, সে অনুযায়ী দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৯ই নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, দেশে এখন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে যা থাকবে সেটাই নেট রিজার্ভ। সেই হিসাবে দেশে নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার।”

আইএমএফের আপত্তি কোথায় ছিল? 

‘বিবিসি নিউজ বাংলা’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রিজার্ভ গণনার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মোট যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আছে, সেটাকেই দেশের নেট রিজার্ভ বলে হিসাব করা হয়। তবে বাংলাদেশে এতদিন রিজার্ভ হিসাব করার সময় হাতে থাকা নেট রিজার্ভের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ বা ঋণ হিসাবে যে ডলার রিজার্ভ থেকে দেয়া হয়েছে, সেটাকেও যোগ করে দেখানো হতো। আইএমএফ এমন পদ্ধতিতে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ব্যবহারযোগ্য যে তহবিল রয়েছে সেটাই রিজার্ভ হিসাবে দেখানো উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের। নাহলে রিজার্ভ নিয়ে সঠিক বার্তা যায় না। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “আমাদের কয়েকটি ফান্ডে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে। সেখান থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে নেট রিজার্ভ চলে আসবে ২৬ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। আমাদের রিজার্ভ যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, তখনও আমরা এভাবেই হিসাব করেছি।”

৮ বিলিয়ন ডলার কোথায় খরচ হয়েছে? 

রিজার্ভ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি বা ৮ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন খাতে খরচ করা হয়েছে।

রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতেও রিজার্ভ থেকে সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। এই খরচের পর রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৩ বিলিয়ন ডলারে। 

মূলত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রিজার্ভ গণনার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মোট যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আছে, সেটাকেই দেশের নেট রিজার্ভ বলে হিসাব করা হয়। তবে বাংলাদেশে এতদিন রিজার্ভ হিসাব করার সময় হাতে থাকা নেট রিজার্ভের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ বা ঋণ হিসাবে যে ডলার রিজার্ভ থেকে দেয়া হয়েছে, সেটাকেও যোগ করে দেখানো হতো। আইএমএফের আপত্তির মুখে গত ৯ নভেম্বর এই পদ্ধতির ব্যবহার থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে এখন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন ডলার হলেও বিভিন্ন খাতে খরচের পর বর্তমান রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সম্প্রতি রিজার্ভের পরিমাণ ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ- এভাবে পাওয়া ডলার নিয়ে রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি, ঋণের সুদ বা কিস্তি দেয়া, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ইত্যাদি খাতে আবার বিদেশি মুদ্রা চলে যায়।

প্রসঙ্গত, এখন দেশে প্রতি মাসে আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। ফলে ২৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ৪ মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয় সামাল দেওয়া যাবে। সামনের দিনগুলোয় এই সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা সামনে রেখে পরিস্থিতি সামলাতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো, রেমিট্যান্স বাড়ানো, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, খাদ্য মজুদ করা ও শুল্ক-কর সহজ করার মতো পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ঘাটতি মেটাতেই আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশের সরকার। এই ঋণ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত কিস্তিতে বিতরণ করা হবে। ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৪৭.৭৮ মিলিয়ন ডলার আসবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। 

সুতরাং, আইএমএফের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের প্রকৃত ‍রিজার্ভ পাওয়া গেছে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img