পাকিস্তানে বন্যা সৃষ্টির দায়ে মুফতি আজিজুর রহমানকে আটকের দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি “পাকিস্তানে বন্যা সৃষ্টির দায়ে মুফতি আজিজুর রেহমানকে আটক করা হয়েছে” এমন একটি দাবি সম্বলিত অসংখ্য পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

যা দাবি করা হচ্ছে

ফেসবুকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ‘আব্দুর রহীম আল মাদানী সমর্থক’ নামক গ্রুপে Ashraf Hussain নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, “ইন্নালিল্লাহ!! উনি একজন মসজিদের ইমাম। অনাবৃষ্টির কারনে ইস্তেসকার নামাজ পড়লেন সবাইকে নিয়ে। দোয়া কবুল হয়ে বৃষ্টি নামল। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা ও জানমালের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। এজন্য পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করে।

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে একজন পুলিশের পাশে সাদা পাঞ্জাবিতে হাতকড়া পরা অবস্থায় এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।  

একই দাবিতে ছড়িয়ে পড়া ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানেএখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

একই দাবিতে পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়া ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানেএখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাকিস্তানে বন্যা সৃষ্টির দায়ে মুফতি আজিজুর রেহমানের আটকের দাবিটি সঠিক নয় বরং ঐ ব্যক্তি যৌন অপরাধের কারণে ২০২১ সালে আটক হন।

রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতির মাধ্যমে, পাকিস্তানের মূল ধারার সংবাদমাধ্যম Dawn এর ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ২০ জুন Mufti Azizur Rehman, sons arrested in separate raids শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত ফিচার ইমেজের সাথে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে সংযুক্ত ছবিটির হুবহু মিল পাওয়া যায়।

Screenshot source : Dawn

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক ছাত্রকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত মুফতি আজিজুর রহমানকে মিয়ানওয়ালিতে একটি অভিযানের সময় ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (সিআইএ) এর একটি দল গ্রেপ্তার করেছে।

Dawn জানিয়েছে, সিআইএ আজিজুল আজিজুর রেহমানের দুই ছেলে আলতাফুর রেহমান এবং আতিকুর রেহমানকেও গ্রেপ্তারের দাবি করে। তাদের বাবার বিরুদ্ধে মামলা করায় ভিকটিমকে ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তাদের দুজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি হুমকির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

ডনের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে পাঞ্জাব পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ইনাম গণির অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে আলোচিত ব্যক্তির আটকের বিষয়ে একটি টুইট খুঁজে পাওয়া যায়। টুইট বার্তায় ইনাম গণি জানান, “আমরা এই অপরাধীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা এটাকে টেস্ট কেস হিসেবে নেব, তাকে জেরা করব, বৈজ্ঞানিক পেশাদার তদন্ত করব, বিচার করব এবং আদালতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করব। আমরা চাই আমাদের বাচ্চারা এই শিশু নির্যাতনকারীদের থেকে সুরক্ষিত থাকুক এবং আমাদের সমাজকে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ রাখুক।”

Screenshot source : Twitter

মুফতি আজিজুর রহমান কি এখনও জেলে?

অনুসন্ধানে মুফতি আজিজুর রেহমানের বিষয়ে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ প্রকাশিত একটি খবর খুঁজে পাওয়া যায়।

পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার জাতীয় দৈনিক Pakistan Observer এর ওয়েবসাইটে চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদন প্রতিবেদনে বলা হয়, মুফতি আজিজুর রেহমানকে আটকের মামলায় একজন মাদ্রাসা ছাত্র বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারী) লাহোরের একটি আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন। তিনি আদালতকে বলেন, মুফতি আজিজ তাকে তিন বছর ধরে যৌন শোষণ করে আসছিলেন। ঐ ছাত্র ২০১৩ সালে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য সেমিনারিতে ভর্তি হয়েছিলেন।

Dawn এর ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো জামিন আবেদন করলেও মুফতি আজিজুরের জামিন আবেদন নাকচ করে দেন লাহোরের আদালত।

অর্থাৎ, মুফতি আজিজুর রেহমান ২০২১ সালের জুনে আটকের পর থেকে জেলে বন্দি আছেন।

মুফতি আজিজুর কি মসজিদের ইমাম?

মুফতি আজিজুর রেহমান লাহোরের জামিয়া মনজুরুল ইসলামিক মাদ্রাসার সেমিনারি শাখার শিক্ষক। ৭০ বছর বয়সী এই শিক্ষক পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের (JUI) একজন নেতা। আজিজুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার ভিত্তিতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাকে অব্যাহতি দেয়। একইসাথে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সদস্যপদটি বাতিল করা হয়। সে সময় মুফতি আজিজুরের বিষয়ে দলটির ভুয়া স্টেটমেন্টও ছড়িয়ে পড়ার খবর আসে পাকিস্তানি গণমাধ্যমে

Screenshot source : pakobsever 

গণমাধ্যমের খবরগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, মুফতি আজিজুর রেহমান মাদ্রাসা শিক্ষক এবং একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হলেও তিনি কোনো মসজিদের ইমাম থাকার তথ্য নেই।

ইসতিসকার নামাজ কী? 

তীব্র তাপপ্রবাহ ও টানা অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ার প্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা আল্লাহর দরবারে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে দোয়া করেন। একেই আরবিতে বলা হয় ‘ইসতিসকা’ অর্থাৎ পানি প্রার্থনা করা। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনায় সম্মিলিতভাবে জামাতে দুই রাকাত ‘ইসতিসকার নামাজ’ আদায় করা হয়।

মূলত, ২০২১ সালের জুনে লাহোরে মুফতি আজিজুর রহমান নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে তার এক ছাত্রকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আসার প্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে আটক করে। কিন্তু সম্প্রতি পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টির জন্য মুফতি আজিজুর রহমানের পড়ানো ইসতিসকার নামাজকে দায়ী করার প্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে আটক করেছে দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ, মুফতি আজিজুর ২০২১ সালে আটকের পর থেকে জেলে বন্দি আছেন।

উল্লেখ্য, চলতি বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বন্যায় পাকিস্তানের এক–তৃতীয়াংশ অঞ্চল ডুবে গেছে। দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, নদীর বাঁধ ভেঙে পড়া ও পাহাড়ি ঢল। এ প্রেক্ষাপটে জুনে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটিতে অন্তত ১ হাজার ১৩৬ জন বন্যার কারণে মারা গেছেন। বন্যায় সরাসরি গৃহহীন হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। এছাড়া এই বন্যায় আর্থিক ক্ষতি ১৮০০ কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পাহাড়ি ঢলের মতো বিষয়গুলোও এই দুর্যোগের জন্য দায়ী বলে বের করেছেন গবেষকরা।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যা নিয়ে গর আগেও গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, পাকিস্তানে বন্যা সৃষ্টির দায়ে মুফতি আজিজুর রেহমানের আটকের দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img