শুক্রবার, মার্চ 29, 2024
spot_img

জুলিয়েট রোজের দাম ও উৎপাদনের সময়সীমা নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার

“ফুলটির নাম জুলিয়েট রোজ” শীর্ষক শিরোনামে একটি ফুলের ছবি সম্বলিত কিছু তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।

যা দাবি করা হচ্ছে

ফেসবুকের পোস্টগুলোতে মূলত তিনটি দাবি রয়েছে – 

দাবি ১ – পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ফুল হলো জুলিয়েট রোজ। কিছু পোস্টে পৃথিবীর দ্বিতীয় দামি ফুল দাবিও এসেছে। 
দাবি ২ – এই গোলাপের প্রতিটির মূল্য ১৫.৮ মিলিয়ন, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। কিছু পোস্টে ১২৬ কোটি টাকার দাবিও দেখা গেছে। 
দাবি ৩ – একেকটি জুলিয়েট রোজ ফুটতে সময় লাগে প্রায় ১৫ বছর।

২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।

২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে।

২০২০ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে

২০১৯ সালে ফেসবুকে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে। (আর্কাইভ)

২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে। (আর্কাইভ)

২০১৭ সালে ফেসবুকে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে। (আর্কাইভ)

২০১৬ সালে ফেসবুকে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে। (আর্কাইভ)

একই দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন – কালের কন্ঠ, যুগান্তর, ডেইলী বাংলাদেশ, প্রতিদিনের সংবাদ, সময় নিউজ, ইত্তেফাক, বিডি মর্নিং, জাগো নিউজ, অধিকার, মানবকন্ঠ, একুশে টিভি, জনকণ্ঠ, শেয়ারবিজ, বিজনেস বাংলাদেশ, আমার সংবাদ এবং ঢাকা টাইমস২৪। 

একই দাবিতে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন – এখানে, এখানে এবং এখানে
আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জুলিয়েট রোজের দাম ও উৎপাদনের সময়সীমার সম্পর্কে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যগুলো সত্য নয় বরং এই তথ্যগুলো ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে ফুলটির উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান থেকেই নিশ্চিত করা হয়েছে।

অনুসন্ধান যেভাবে

কিওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতিতে জাতীয় দৈনিক ‘কালের কন্ঠ’ পত্রিকার ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালে জুলিয়েট রোজ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “জুলিয়েট গোলাপের দাম ১ কোটি টাকারও বেশি। ২০০৬ সালে চেলসি পুষ্প প্রদর্শনীতে প্রথম গোটা দুনিয়ার নজর কাড়ে ফুলটি। এই গোলাপ বিখ্যাত ফুল বিশেষজ্ঞ ডেভিড অস্টিন দ্বারা বিকশিত হয়েছিল। বিকশিত করতে প্রায় ১৫ বছর সময় লাগে এবং প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।” 

এই তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড অস্টিন একজন গোলাপ প্রজননকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে প্রথম তিনি গোলাপ উদ্ভাবন শুরু করেন। জীবদ্দশায় তিনি দুই শতাধিক ইংরেজি গোলাপ উদ্ভাবন করেন। তিনি ২০১৮ সালে মারা যান। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘David Austin Roses’ এর মাধ্যমে বর্তমানে গোলাপের ব্যবসাটি পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ডেভিড অস্টিনের ফুলের চাহিদা রয়েছে। 

প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে জুলিয়েট রোজ বিষয়ক কিছু তথ্যও খুঁজে পাওয়া যায়।

মূলত, বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হতে দেখা যায় জুলিয়েট রোজকে।

ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, জুলিয়েট তার ট্রেডমার্ক উজ্জ্বল পীচ রঙ এবং তার স্বতন্ত্র রূপ উভয়ের জন্য তার বিশ্ব বিখ্যাত মর্যাদা পেয়েছে। যদিও তার সুবাস অধরা, তার মার্জিত সৌন্দর্য নিশ্চিত করে যে, সে আমাদের সংগ্রহের আইকনিক একটি ফুল।

তবে জুলিয়টে রোজ সম্পর্কে প্রচারিত দাবিগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্য মেলেনি উক্ত ওয়েবসাইটে। 

পরবর্তীতে এ বিষয়ে জানতে ‘David Austin Roses’ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, জুলিয়েট রোজের বিষয়ে অনলাইন আর্টিকেল এবং পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই ভুল তথ্য প্রকাশ হয়। আমাদের পাঠানো দাবিগুলোর বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়

দাবি ১ – পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ফুল হলো জুলিয়েট রোজ।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ‘David Austin Roses’ এর জনসংযোগ কর্মকর্তা এ্যামি ম্যাককেন (Amy McCann) রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “জুলিয়েটকে প্রায়শই বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল গোলাপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যা সত্য নয়।” 

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ফুল কোনটি এমন প্রশ্নে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বৈশ্বিক ফুল এবং উপহারের খুচরা বিক্রেতা ‘অ্যারেনা ফ্লাওয়ার্স’ (Arena Flowers) -এর ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

‘অ্যারেনা ফ্লাওয়ার্স’ বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ফুলের নাম কাদুপুল (KADUPUL)। যার মূল্য নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। এই ফুল এতই ক্ষণস্থায়ী আর নাজুক যে আজ পর্যন্ত কেউই একে তার কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে অক্ষতরূপে অন্য কাউকে উপহার দিতে পারেননি।

‘অ্যারেনা ফ্লাওয়ার্স’ এর তৈরি করা সবচেয়ে দামি ফুলের তালিকার পরের চার অবস্থানে আছে Shenzhen Nongke Orchid , Gold of Kinabalu Orchid, Bouquet  Consisted of white orchids, White lilies, Moonflowers and the Root of A 100 year old ficus এবং Saffron Crocus।

এই তালিকায় থাকা ফুলগুলোর দাম ১ লাখ ৬৬ হাজার ডলার থেকে সর্বনিম্ন ৬২২ ডলার পর্যন্ত। 

অর্থাৎ, সবচেয়ে দামি পাঁচ ফুলের তালিকায় জুলিয়েট রোজ নেই।

দাবি ২ – এই গোলাপের প্রতিটির মূল্য ১৫.৮ মিলিয়ন, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৩৬ কোটি টাকা।

রিউমর স্ক্যানারের সাথে আলাপকালে এ্যামি ম্যাককেন জানিয়েছেন, জুলিয়েট রোজ তাদের ১৬ টি কাট রোজ ফুলের মধ্যে একটি। এগুলোর প্রতিটি স্টেম বা স্টিক পাইকারি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩.৫০ ডলার দামে বিক্রি হয়।

অর্থাৎ, প্রতিটি জুলিয়েট রোজের দাম ১৫.৮ মিলিয়ন ডলার বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি জুলিয়েট রোজ পাইকারি দরে সাড়ে তিন ডলারে বিক্রি হয়। 

কিন্তু জুলিয়েট রোজের সাথে এমন আকাশচুম্বী দামের ব্যাপারটি জড়ালো কীভাবে – এমন প্রশ্নে এ্যামি ম্যাককেন রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “ব্যাপারটি যেখান থেকে এসেছে তা হল জুলিয়েট আমাদের ১৫ বছরের একটি প্রজনন প্রোগ্রামের অংশ ছিল। এরপরে এটি উদ্ভাবিত হয়েছিল। একটি প্রজনন প্রোগ্রামের জন্য প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। এর ফলস্বরূপ, লোকেরা প্রজননের সাথে জড়িত বৃহৎ ব্যয়ের উদ্ধৃতি দেয় এবং এটি জুলিয়েটের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে।”

দাবি ৩ – একেকটি জুলিয়েট রোজ ফুটতে সময় লাগে প্রায় ১৫ বছর।

দুই নম্বর দাবির প্রশ্নের উত্তরেই এ্যামি ম্যাককেন পরিষ্কার করেছেন যে প্রথম যখন জুলিয়েটের প্রজনন প্রোগ্রাম করা হয়েছিল তখন তাতে সময় লেগেছিল ১৫ বছর। প্রজনন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ফুলটি উদ্ভাবন করা হয়েছিল। প্রজনন প্রোগ্রামে সাধারণত নানান গবেষণা করা হয়, যাতে সময় বেশি লাগে। এতে করে একেকটি প্রজনন প্রোগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হয় বছরের পর বছর। জুলিয়েট রোজের প্রজনন প্রোগ্রামের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে।

কিন্তু ঠিক কতদিন সময় লাগে একেকটি জুলিয়েট রোজ ফুটতে – এমন প্রশ্নে এ্যামি ম্যাককেন রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, পাঁচটি চাষাবাদকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ফুলের চাষ করে থাকেন। তারা যেহেতু সরাসরি চাষ করেন না, সেহেতু তাদের পক্ষে একেকটি ফুলের চাষের উৎপাদন সময়সীমা সম্পর্কে বলা মুশকিল। 

তবে এ্যামি জানিয়েছেন, একেকটি নতুন জাতের গোলাপের প্রজনন করাতে তাদের প্রায় নয় বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। 

অর্থাৎ, একেকটি জুলিয়েট রোজ ফুটতে প্রায় ১৫ বছর সময় লাগার তথ্যটি সঠিক নয়। বরং ফুলটির প্রথম প্রজনন প্রোগ্রামে ১৫ বছর সময় ব্যয় হয়েছিল। 

মূলত, ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড অস্টিন ১৫ বছরের একটি ব্যয়বহুল প্রজনন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ‘জুলিয়েট রোজ’ নামে গোলাপের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেন। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরেই এই ফুলকে সবচেয়ে দামী ফুল, এর প্রতিটির মূল্য শতাধিক কোটি টাকা এবং একেকটি ফুল ফুটতে ১৫ বছর সময় লাগার দাবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু অস্টিনের প্রতিষ্ঠান থেকে বিষয়গুলো সত্য নয় নিশ্চিত করে রিউমর স্ক্যানারকে জানানো হয়, প্রতিটি জুলিয়েট রোজের পাইকারি মূল্য সাড়ে তিন ডলার। তাই এটি সবচেয়ে দামি ফুলও নয়। এমনকি এই ফুল ফুটতে ১৫ বছর সময় লাগার দাবিটিও সঠিক নয়।

প্রসঙ্গত, আজানের শব্দে ‘আজান ফুল’ ফোটা বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, জুলিয়েট রোজ ফুলের দাম ও উৎপাদনের সময়সীমার বিষয়ে কিছু তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img