সম্প্রতি, ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’ শীর্ষক একটি তথ্য ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে রয়েছে শীর্ষক একটি দাবি বেশ কিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এসেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন ইত্তেফাক, আমাদের সময়, ইনকিলাব, দৈনিক শিক্ষা, দেশ রূপান্তর, বাংলাদেশ টুডে।
গণমাধ্যমে মতামত বিভাগে প্রকাশিত একটি কলাম দেখুন নয়া দিগন্ত।
গণমাধ্যমের প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন ইত্তেফাক (১,২), দেশ রূপান্তর (১,২)।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি শীর্ষক তথ্য ষষ্ঠ শ্রেণির বইতে রয়েছে দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয় বরং উক্ত বইতে তথ্যটি ভুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের ভুলের বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বত্র বেশ আলোচনা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শীর্ষক একটি তথ্য গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
এ বিষয়ে গত ২৬ জানুয়ারী জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক এর প্রিন্ট (১,২) এবং অনলাইন সংস্করণে “পাঠ্যবই থেকে বাদ যাচ্ছে ডারউইনের তত্ত্ব!” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিতর্কের শীর্ষে রয়েছে ডারউইনের তত্ত্বের বিষয়টি, যেটি ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’।”
একই প্রতিবেদন হুবহু প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ টুডে, যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’ শীর্ষক তথ্যটিও এসেছে।
জাতীয় দৈনিক ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকার ওয়েবসাইটে গত ২০ জানুয়ারী চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) প্রফেসর ইমেরিটাস ও সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর এ কে এম আজহারুল ইসলামের লেখা একটি কলামেও একই তথ্য এসেছে।
কিন্তু রিউমর স্ক্যানার পূর্বেই একই প্রসঙ্গে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণির বইতে ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’ শীর্ষক কোনো তথ্য নেই।
রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধান করে দেখেছে, ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইটির ২১ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত “মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?” শিরোনামের পাঠ্যটির ২১ এবং ২৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি। বরং বইতে ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’ শীর্ষক কথাটিকে ভুল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তাছাড়া, ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বিবর্তনের যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে সেটিও আলোচিত পাঠ্যবইয়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইত্তেফাক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, “এই মতবাদ ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী বইয়ের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে বানর ছিল, আর সেখান থেকেই কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। বইয়ের ১১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস’ ঠিক তার পরের পৃষ্ঠায় অর্থাৎ ১১৫ পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শিরোনাম দিয়ে চারটি ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে মূলত বানর ছিল। আর তার পরেই কয়েকটি ধাপে বানর থেকেই মানুষের আকৃতি রূপান্তরিত হয়েছে।”
একই তথ্য এসেছে ২৬ জানুয়ারী জাতীয় দৈনিক ‘দেশ রূপান্তর’ পত্রিকায় এবং ২০ জানুয়ারী আরেক জাতীয় দৈনিক ‘ইনকিলাব’ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনেও।
তবে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুশীলন বইয়ের ১১৫ নং পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শীর্ষক শিরোনামের পাঠ্যটির যে ছবিগুলোকে কেন্দ্র করে আলোচনা হচ্ছে সেগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ছবিগুলো দেখুন
প্রথম ছবিটির নিচে অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) লেখা রয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘Nature’ থেকে জানা যায়, অস্ট্রালোপিথেকাস হল আধুনিক মানব জাতির (Homo Sapiens Sapiens) পূর্বপুরুষ। মানব-সম জীবের [Hominid] মধ্যে অস্ট্রলোপিথেকাস হল সর্বপ্রাচীন। মনে করা হয় যে, অস্ট্রলোপিথেকাস প্রায় ২০ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে বাস করত। এদের হাত, বাহু ও কাঁধ আধুনিক মানুষের মত না। তবে আধুনিক মানুষের সাথে যথেষ্ট সাদৃশ্য ছিল।
বইয়ের পরের তিনটি ছবি হচ্ছে যথাক্রমে হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis), হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) এবং হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens)।
উক্ত সবগুলো ছবির বিষয়েই অনুসন্ধান করে জানা যায়, এরা সকলেই মানুষের বিভিন্ন সময়ের পূর্ব পুরুষ ছিল।
এ বিষয়ে জানুন, হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis), হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) এবং হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens)।
শেষ ছবিটি (Homo Sapiens Sapiens) আধুনিক মানুষের, যাদের তিন লক্ষ বছর আগে উদ্ভব ঘটেছিল বলে উল্লেখ আছে একই বইতে।
অর্থাৎ, ছবিগুলোর কোনোটিই বানরের নয় বরং এরা মানুষেরই বিভিন্ন সময়ের আদি ও বর্তমান রূপ।
মূলত, সম্প্রতি মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শীর্ষক তথ্য উল্লেখ রয়েছে বলে গণমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে। তবে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুশীলন বই যাচাই করে দেখা যায়, সেখানে বানরের ছবি থাকার যে দাবি করা হচ্ছে তা বানরের নয় বরং ছবিগুলো মানুষেরই বিভিন্ন সময়ের আদি ও বর্তমান রূপ। তাছাড়া, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের “মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?” শিরোনামের পাঠ্যটিতে ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে’ শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি বরং বিষয়টি ভুল বলে বইটির একাধিক পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, একই বিষয়ে সম্প্রতি বিস্তারিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’ শীর্ষক তথ্য ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইতে থাকার দাবি গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Nature: Australopithecus and Kin
- ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান: অনুসন্ধানী পাঠ
- ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান: অনুশীলন বই