সম্প্রতি, “বানর থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে” শীর্ষক একটি তথ্য ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে রয়েছে শীর্ষক একটি দাবি এবং একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে ৷
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি শীর্ষক তথ্য ষষ্ঠ শ্রেণীর বইতে থাকার বিষয়টি সঠিক নয় বরং উক্ত বইতে তথ্যটি ভুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের ভুলের বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বত্র বেশ আলোচনা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শীর্ষক একটি তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধান যেভাবে
ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে বইয়ের পৃষ্ঠার একটি ছবি সংযুক্ত রয়েছে। ছবির উপরের দিকে বইয়ের নাম ‘ইতিহাস ও সামাজিকতা বিজ্ঞান’ উল্লেখ রয়েছে।
বইটিকে ষষ্ঠ শ্রেণীর হিসেবে দাবির প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করে জানা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বই দুইটি। একটি হচ্ছে অনুসন্ধানী পাঠ এবং অন্যটি হচ্ছে অনুশীলন বই।
ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুশীলন বই যাচাই করে দেখা যায়, বইটির ১১৫ নং পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শীর্ষক শিরোনামের একটি পাঠ্য রয়েছে। উক্ত পাতার সাথে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোর ছবিটির মিল পাওয়া যায়।
তবে উক্ত পাতায় বানর থেকে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে এমন কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “সহায়ক বইতে মানুষ ও সমাজ কোথা থেকে এলো অংশে এরকম মানচিত্রও আছে যেখানে প্রাচীন মানুষেরা কোথা থেকে কোথায় গেছে তা দেখানো হয়েছে। “
ছবি বিশ্লেষণ
ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুশীলন বইয়ের ১১৫ নং পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শীর্ষক শিরোনামের পাঠ্যটির যে ছবিগুলোকে কেন্দ্র করে আলোচনা হচ্ছে সেগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ছবিগুলো দেখুন–
প্রথম ছবিটির নিচে অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus) লেখা রয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘Nature’ থেকে জানা যায়, অস্ট্রালোপিথেকাস হল আধুনিক মানব জাতির (Homo Sapiens Sapiens) পূর্বপুরুষ। মানব-সম জীবের [Hominid] মধ্যে অস্ট্রলোপিথেকাস হল সর্বপ্রাচীন। মনে করা হয় যে, অস্ট্রলোপিথেকাস প্রায় ২০ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে বাস করত। এদের হাত, বাহু ও কাঁধ আধুনিক মানুষের মত না। তবে আধুনিক মানুষের সাথে যথেষ্ট সাদৃশ্য ছিল।
বইয়ের পরের তিনটি ছবি হচ্ছে যথাক্রমে হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis), হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) এবং হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens)।
উক্ত সবগুলো ছবির বিষয়েই অনুসন্ধান করে জানা যায়, এরা সকলেই মানুষের বিভিন্ন সময়ের পূর্ব পুরুষ ছিল।
এ বিষয়ে জানুন, হোমো হ্যাবিলিস (Homo habilis), হোমো ইরেক্টাস (Homo erectus) এবং হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens)।
শেষ ছবিটি (Homo Sapiens Sapiens) আধুনিক মানুষের, যাদের তিন লক্ষ বছর আগে উদ্ভব ঘটেছিল বলে উল্লেখ আছে একই বইতে।
অর্থাৎ, ছবিগুলোর কোনোটিই বানরের নয় বরং এরা মানুষেরই বিভিন্ন সময়ের আদি ও বর্তমান রূপ।
‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুসন্ধানী পাঠে কী আছে?
ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুশীলন বইয়ের ১১৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) বই থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের মানুষ ও সমাজ কোথা থেকে এলো বের করো।”
এ বিষয়ে জানতে তাই ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইটির ২১ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত “মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?” শিরোনামের পাঠ্যটি পড়ে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
২১ পৃষ্ঠায় পাঠ্যের শুরুর পাতায় বলা হয়েছে, “অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব হয়েছে নাকি বানর থেকে৷ এ কথা ভুল।”
২৩ পৃষ্ঠায় জানতে চাওয়া হয়েছে, “আচ্ছা, আমাদের পূর্ব প্রজন্মের মানুষেরা লক্ষ লক্ষ বছর আগে কি আসলেই বানর ছিল?”
২৪ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এসেছে। লেখা রয়েছে, “আমাদের প্রথমে মনে রাখতে হবে যে আধুনিক মানুষ এবং বানর-গোত্রের নানা প্রাণী (যেমন, শিম্পাঞ্জি, গরিলা) একটি সাধারণ প্রাইমেট জাতীয় প্রজাতি থেকে যাত্রা শুরু করেছে।”
পরের প্যারায় এসেছে, “প্রাইমেট জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে একদিকে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটাং ও গিবনের মতন এপ-জাতীয় প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। অন্যদিকে বানর তৈরি হয়েছে। আর একটি ধারায় মানুষ ধীরে ধীরে বিকশিত নানান পর্যায়ে৷”
একই পাতায় বলা হয়েছে, “বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি। বরং মানুষ, শিম্পাঞ্জিসহ এপ-রা আর বানরের বিভিন্ন প্রজাতি একই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে।”
অর্থাৎ, ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি বরং মানুষ আর বানরের বিভিন্ন প্রজাতি একই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানুষ ও বানর কি একই প্রাইমেট বর্গের?
জীবজগতের সকল জীব সম্পর্কে জানার সুবিধার্থে সকল জীবের প্রজাতিকে নিয়ে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। শ্রেণীবিন্যাসের সাতটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হল, জগৎ (Kingdom), পর্ব (Phylum), শ্রেণী (Class), বর্গ (Order), গোত্র (Family), গণ (Genus) এবং প্রজাতি (Species)।
মানুষসহ সকল প্রাণীই এ্যানিমেলিয়া জগতে পড়েছে। একইভাবে আঁকড়ে ধরার উপযোগী হাত এবং ঘ্রাণ অপেক্ষা দৃষ্টিশক্তি বেশি উন্নত হওয়ার মতো কিছু বৈশিষ্ট্য থাকায় মানুষ, বানরসহ সম বৈশিষ্ট্যের সকল প্রাণীকেই প্রাইমেট বর্গে স্থান দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ, মানুষ ও বানর একই প্রাইমেট বর্গের প্রাণী।
মূলত, সম্প্রতি মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শীর্ষক তথ্য উল্লেখ রয়েছে বলে ফেসবুকে দাবি করা হচ্ছে। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুশীলন বই যাচাই করে দেখা যায়, সেখানে বানরের ছবি থাকার যে দাবি করা হচ্ছে তা বানরের নয় বরং ছবিগুলো মানুষেরই বিভিন্ন সময়ের আদি ও বর্তমান রূপ। তাছাড়া, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের “মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?” শিরোনামের পাঠ্যটি পড়ে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। সেখানে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি বরং এই তথ্যকে ভুল জানিয়ে মানুষ আর বানরের বিভিন্ন প্রজাতি একই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুতরাং, মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি শীর্ষক তথ্য ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইতে থাকার দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Nature: Australopithecus and Kin
- ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান: অনুসন্ধানী পাঠ
- ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান: অনুশীলন বই