সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের শিক্ষার মান ১৩৮ টা দেশের মধ্যে ১২৩ তম যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।‘ শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, শিক্ষার তিনটি বৈশ্বিক সূচকের সবশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিক্ষার মান ১৩৮ টা দেশের মধ্যে ১২৩ তম দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক নয় বরং এই তিনটি সূচকের দুইটিতেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং একটিতে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার সবার নিচে।
দাবিটির সত্যতা অনুসন্ধানে উক্ত দাবিতে প্রচারিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলোতে কোনো তথ্যসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এছাড়া মূলধারার কোনো গণমাধ্যমেও এমন কোনো তথ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বাংলার ফেসবুক পেইজে ২০২২ সালের ২৪ জুন ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে৷‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে ২০২১ সালের শিক্ষার তিনটি বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, তিনটি সূচকের মধ্যে দুইটি বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে।
২০২১ সালের তিনটি বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান
২০২১ সালের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৫৪ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০ তম। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থান ছিল যথাক্রমে পাকিস্তান (১২৩), নেপাল (১২৮) ও আফগানিস্তান (১৫১)৷ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে ছিল শ্রীলঙ্কা (৮৬)। ভারত ও ভুটান আছে যথাক্রমে ৯৭ ও ১০৮তম স্থানে৷
ফ্রান্সভিত্তিক বিজনেস স্কুল ‘ইনসিয়েড’ ও ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘পোর্টল্যান্স ইনস্টিটিউটের’ ২০২১ সালের ‘গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে’ ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ তম। এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার নীচে। এই অঞ্চলে শীর্ষে ছিল ভারত (৮৮)। এরপর ছিল শ্রীলঙ্কা (৯৩), পাকিস্তান (১০৭) ও নেপাল (১১৩)৷
এছাড়া জাতিসংঘের সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ নম্বরে৷ এই সূচকেও দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নীচে ছিল বাংলাদেশ। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত (৪৬), শ্রীলঙ্কা (৯৫), পাকিস্তান (৯৯) ও নেপাল (১১১) তম অবস্থানে ছিল।
উক্ত তিনটি সূচকে বাংলাদেশের সবশেষ অবস্থান কত?
পরবর্তীতে উক্ত সূচকগুলোতে বাংলাদেশের সবশেষ অবস্থান সম্পর্কে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। এক্ষেত্রে উক্ত তিনটি সূচকেরই সবশেষ হালনাগাদ যাচাই করে দেখা হয়।
এতে দেখা যায়, বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক ২০২২ এ ১৩২ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫ তম। যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ, বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা, ভূটান ও ভারত। সূচকে দেশগুলোর অবস্থান শ্রীলঙ্কা ৭৯ তম, ভূটান ৮৯ তম এবং ভারত ৯১ তম।
সূচকে বাংলাদেশের নিচের অবস্থানে রয়েছে নেপাল ১০৮ তম এবং পাকিস্তান ১১০ তম।
এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের কোনো অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর প্রকাশিত গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স বা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩ টি দেশের মধ্যে ১২২ তম।
এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে আছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত ১০১ তম, পাকিস্তান ১১৩ তম, শ্রীলঙ্কা ৯৩ তম এবং নেপালের অবস্থান ১১১ তম।
তবে এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের কোনো অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক ২০২২ এর সবশেষ হালনাগাদ যাচাই করে দেখা যায়, বাংলাদেশ এই সূচকে বিশ্বের ১৩২ টি দেশের মধ্যে ১০২ তম অবস্থানে আছে।
এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে ভারত ৪০ তম, দ্বিতীয় স্থানে থাকা শ্রীলঙ্কা ৮৫ তম ও তৃতীয় স্থানে থাকা পাকিস্তান ৮৭ তম এবং পঞ্চম স্থানে থাকা নেপালের অবস্থান ১১১ তম।
এই সূচকেও দক্ষিণ এশিয়ার ভূটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের কোনো অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার তিনটি বৈশ্বিক সূচকের ২০২২ সালের সবশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ কেবল গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স বা সূচকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে স্থান পাওয়া অন্যান্য দেশগুলো থেকে পিছিয়ে আছে। বাদ বাকী অন্য দুইটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থতম।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের তালিকায় ১৩৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম ছিল। যা সেসময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল।
মূলত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের শিক্ষার মান ১৩৮ টা দেশের মধ্যে ১২৩ তম যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।’ শীর্ষক একটি তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত তথ্যটি কোনো ধরনের তথ্যসূত্র ছাড়াই প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার তিনটি বৈশ্বিক সূচক যথা, বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক, বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক ও গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স বা সূচকের সবশেষ হালনাগাদ যাচাই করেও এই দাবির পক্ষে কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে ২০২২ সালেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ”বাংলাদেশের শিক্ষার মান ১৩৮ টি দেশের মধ্যে ১১২ তম এবং এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য প্রচার হলে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে তথ্যটি মিথ্যা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘বাংলাদেশের শিক্ষার মান ১৩৮ টা দেশের মধ্যে ১২৩ তম যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।’ শীর্ষক যে দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে; সেটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- DW Bangla: দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে
- knowledge4all: Global Knowledge Index2022
- insead.edu: Global Talent Competitiveness Index
- Wipo.int: Global Innovation Index2022
- The Daily Star: Global Knowledge Index 2020: Bangladesh ranks lowest in South Asia