চলতি বছরের মে মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ৩৫১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। গত বছরের আগস্টের পর এক মাসে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের সংখ্যা। আগস্টে শনাক্ত হয়েছিল ৩৮৬টি ভুল তথ্য।
রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে গত মে মাসে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক থেকে গণনাকৃত এই সংখ্যার মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি (১৪৩) ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মিলেছে, যা মোট ভুল তথ্যের ৪১ শতাংশ। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিষয়ে ৮৭টি, জাতীয় বিষয়ে ৬৪টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে ২২টি, প্রতারণা বিষয়ে ১৩টি, খেলাধুলা বিষয়ে ১০টি, ধর্মীয় বিষয়ে ছয়টি, শিক্ষা বিষয়ে দুইটি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে মে মাসে।
এসব ঘটনায় ভিডিও কেন্দ্রিক ভুলই ছিল সবচেয়ে বেশি, ১৫১টি। এছাড়া তথ্য কেন্দ্রিক ভুল ছিল ১২৮টি এবং ছবি কেন্দ্রিক ভুল ছিল ৭২টি। শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ২৩০টি, বিকৃত হিসেবে ৬৪টি এবং বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৫৬টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়া, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে একটি।
প্লাটফর্ম হিসেবে গত মাসে ফেসবু্কে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, সংখ্যার হিসেবে যা ৩৩৩টি। এছাড়া ইনস্টাগ্রামে ৭৪টি, ইউটিউবে ৬৫টি, এক্সে ৩২টি, টিকটকে ১৯টি, থ্রেডসে পাঁচটি এবং হোয়াটসঅ্যাপে অন্তত একটি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। ২৩টি ঘটনায় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনায় থাকলেও সম্প্রতি তা কিছুটা হ্রাস পেতে দেখা যাচ্ছে। মে মাসে পাঁচটি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে তিনটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গেল মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ১০টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ভুলতথ্যগুলোর ধরণ বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুইটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে৷ সরকারের পক্ষে যায় এমন ভুল তথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব অপতথ্যের সবগুলোতেই সরকারকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মে মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ১৫টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রেই (১৪টি) তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে), মাহফুজ আলমকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে), জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে), আ ফ ম খালিদ হোসেনকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে), সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে জড়িয়ে দুইটি (সবগুলোই বিপক্ষে), আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) এবং ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে সর্বত্র। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গেল মাসে অন্তত ১১টি অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানার গেল মাসের ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণে দেখেছে, এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি (৪৪টি) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে ১৬টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে যার ৮৭ শতাংশই দলটির পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। মে মাসে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে জড়িয়ে চারটি (৭৫ শতাংশই পক্ষে) এবং যুবলীগকে জড়িয়ে একটি অপতথ্য (বিপক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে এই সময়ে ছয়টি অপতথ্য (সবগুলোই পক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে।
আওয়ামী লীগের পর মে মাসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), তার অঙ্গসংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য (৩৮টি) প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে বিএনপিকে জড়িয়ে ১০টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার ৭০ শতাংশই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে নয়টি (৬৭ শতাংশ বিপক্ষে) এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে পাঁচটি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে জড়িয়ে এই সময়ে পাঁচটি (সবগুলোই বিপক্ষে) এবং যুবদলকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
এছাড়া, মে মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, তার অঙ্গসংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে ২৯টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে পাঁচটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে এই সময়ে ১১টি অপতথ্য (সবগুলোই বিপক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে এই সময়ে নয়টি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও দলটির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গত মাসে ৩২টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে এনসিপিকে জড়িয়ে সাতটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে গত মাসে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে গত মাসে। এছাড়া দলটির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহকে জড়িয়ে ১৬টি (সবগুলোই বিপক্ষে), সারজিস আলমকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), তাসনিম জারাকে জড়িয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে), আব্দুল হান্নান মাসউদকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার দেখা গেছে।
ভুল তথ্যের রোষানল থেকে রক্ষা পায়নি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও। গেল মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে চারটিসহ এই বাহিনীকে জড়িয়ে ১১টি ভুল তথ্য প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে জড়িয়ে পাঁচটি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে জড়িয়ে দুইটি এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে জড়িয়ে একটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
গেল মাসের ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত হয়েছে ৩১টি। একই সময়ে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে ছয়টি।
মে মাসের শুরুর দিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বহু ভুল তথ্য ছড়ায়, নিয়মিত প্রচার হয় পুরোনো ছবি কিংবা ভিন্ন ঘটনার ভিডিও। ভুয়া ছবি-ভিডিও তৈরিতে ব্যবহার হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও। এসব ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে রিউমর স্ক্যানার গেল মাসে এ সংক্রান্ত অন্তত ৬৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে। এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। একইসাথে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভুয়া তথ্যের প্রবাহও লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার। এই ইস্যুতে গত মাসে অন্তত ১৬টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। এছাড়া, গেল মাসের শেষদিকে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত মাসে অন্তত ছয়টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।
গত মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৮০টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ৩১টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৮৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারে মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির নাম সবচেয়ে বেশি (১৫) ব্যবহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমটির পর কালের কণ্ঠ (১২) ও কালবেলা (৭) এর নাম বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।
বার্তা প্রেরক
তানভীর মাহতাব আবীর
জ্যেষ্ঠ ফ্যাক্টচেকার,
রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ।
[email protected]