ফের আলোচনায় সেন্টমার্টিন, বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাজিক মাধ্যমে

বাংলাদেশের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ঘিরে প্রায়ই গুজব এবং অপতথ্য ছড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলতি বছরও বিভিন্ন সময়ে এই দ্বীপ ঘিরে ভুয়া তথ্যের প্রবাহ লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ গেল আগস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দখল করে নিয়েছে এবং সেখানে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ঘাঁটি তৈরি করেছে। রিউমর স্ক্যানার পরবর্তীতে যাচাই করে দেখে, প্রচারিত ভিডিওটি যুক্তরাষ্ট্রে সেনা প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে ২০২১ সালের একটি দৃশ্য; যার সাথে সেন্টমার্টিনের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্প্রতি এই দ্বীপ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। 

ঢাকা সেনানিবাসে গত ৩০ থেকে ৩১ অক্টোবর দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ৮ম ল্যান্ড ফোর্সেস টক ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক আর্মি কমান্ড (USARPAC) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার একটি স্বাক্ষরের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে কেউ দাবি করছেন, সেন্টমার্টিন হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কেউ প্রশ্ন রেখেছেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে চুক্তি হয়ে গেল কিনা। এসব পোস্টে অনেক নেটিজেনকেই এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করতে দেখা গেছে৷  

Collage: Rumor Scanner 

রিউমর স্ক্যানার বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখেছে, উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকে সেন্টমার্টিন নিয়ে কোনো আলোচনা বা চুক্তি হয়নি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, এই বৈঠকে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করেন। এই আলোচনা পর্বে উভয় পক্ষই সামরিক সহযোগিতা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কৌশলগত সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। 

আইএসপিআর বলছে, সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একাধিক যৌথ প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন, উদ্ভাবনী প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এবং অধিকতর কার্যকর যৌথ সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। 

এ সংক্রান্ত আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে এতে সেন্টমার্টিন সংক্রান্ত কোনো আলোচনার তথ্য মেলেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকেও জানানো হয়েছে, এই বৈঠকে সেন্টমার্টিন নিয়ে কোনো আলোচনার হওয়ার বিষয়টি গুজব। প্রেস উইং বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একাধিক বার বিষয়টি পরিস্কার করে জানিয়েছে যে, বিদেশি কোনো দেশকে দ্বীপটি ইজারা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। 

আলোচিত এই বৈঠকটি যে এবারই প্রথম হয়নি এবং এটি যে একটি ধারাবাহিক বৈঠক আয়োজন তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে এই বৈঠকের শিরোনাম ‘৮ম ল্যান্ড ফোর্সেস টক ২০২৪’ দেখে। অর্থাৎ, এই বৈঠকটি পূর্বে আরো সাত বার হয়েছে। ৭ম বৈঠকটি হয় গত বছরের (২০২৩) ১৪ থেকে ১৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে। ইউএস আর্মি প্যাসিফিকের এক্স অ্যাকাউন্টে সে সময়ে হওয়া বৈঠকেও এমন স্বাক্ষরের ছবি পাওয়া যায়। 

Screenshot: X 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে রাজনীতির মাঠে আলোচনার সূত্রপাত ২০২৩ সালে। জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর দাবি, সে বছরের ১৪ জুন সেন্টমার্টিনের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আনেন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি জাতীয় সংসদে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়, কোয়াডে (যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোট) বাংলাদেশকে চায়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, এটি ঠিক নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ নেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনো কোনো আলোচনা করেনি। 

এদিকে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সেন্টমার্টিন সংশ্লিষ্ট অপপ্রচারের মধ্যেই অন্তত ০১ নভেম্বর থেকে ফেসবুক এবং এক্সের কিছু পোস্টে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বর্তমান অবস্থা হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, সাগরে মাছ ধরা বন্ধ। পর্যটক আসা সম্পূর্ন বন্ধ। হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ তিনমাস। বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পুর্ন শাট ডাউন। 

Screenshot: Facebook 

রিউমর স্ক্যানার এ সংক্রান্ত চারটি দাবিই যাচাই করে দেখেছে। 

প্রথমত, প্রতি বছর মা ইলিশ রক্ষা ও নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে নদী ও সাগরে ২২ দিন মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ বছরও ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, মজুদ ও বিপণন বন্ধ রয়েছে। গত বছরও একই সময়ে এই নিষেধাজ্ঞা ছিল। অর্থাৎ, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

দ্বিতীয়ত, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত ২২ অক্টোবর জানায়, সেন্টমার্টিনে চার মাস পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসে (নভেম্বরে) পর্যটকেরা যেতে পারলেও রাত্রিযাপন করতে পারবেন না। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে যেতে পারবেন, থাকতেও পারবেন। তবে এ সময় দিনে দুই হাজারের বেশি পর্যটক দ্বীপে যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো পর্যটক সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন না। অর্থাৎ, পর্যটক আসা বন্ধ শীর্ষক দাবিটিও সঠিক নয়।  

তৃতীয়ত, সেন্টমার্টিনে ২০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালটিতে প্রায় এক মাস ধরে নেই কোনো ডাক্তার ও নার্স। ফলে হাসপাতালে কোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না দ্বীপের বাসিন্দারা। সরকারিভাবে এমবিবিএস ডাক্তার ও নার্স থাকার কথা থাকলেও গত কয়েক বছরে একটি এনজিও মেডিকেল টিমের মাধ্যমে এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিল। ওই প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারাও চলে গেছেন। টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রণয় রুদ্র বলছেন, বর্তমানে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সেবা দিতে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডাক্তার পাঠানো হয়। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

চতুর্থত, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে সেন্টমার্টিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা ব্লু-মেরিন এনার্জি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছে, সোলার প্রজেক্টগুলোর টোকেন রিচার্জ সফটওয়্যারের সার্ভারে সমস্যার কারণে দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। তারা বলছেন, “রিচার্জ সফটওয়্যার সমস্যার সমাধান হয়েছে। আমরা দ্রুত রিচার্জ টোকেন গ্রাহকদের পাঠাচ্ছি।” অর্থাৎ, এক দিনেরও কম সময়ের ব্যবধানে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়েছে দ্বীপটিতে। 

আলোচিত এই চার দাবির বিষয়ে অনুসন্ধানে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই ঘটনা বা সমস্যাগুলো সাধারণ বা স্বাভাবিক বিষয়। এর সাথে দ্বীপটি ইজারা বা অন্য দেশের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img