বুধবার, অক্টোবর 9, 2024

এ.আই দ্বারা তৈরি ছবি ও ভিডিও যাচাইয়ের সম্ভাব্য উপায়

আদিম মানুষ থেকে বর্তমান মানুষ; এই যাত্রায় নানা আবিষ্কার আর প্রক্রিয়ার ব্যবহার এবং শিল্প বিপ্লব ভূমিকা রেখেছে ঢের। বিপ্লবের তিনটি পর্ব পার হয়ে আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে বিগ ডাটা, থ্রিডি প্রিন্টিং, আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিক্স, ড্রোন, সেন্সর প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং, অগমেন্টেড রিয়ালিটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ব্লকচেইন ইত্যাদি অন্যতম। প্রযুক্তির সুবিধার অপব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এ.আই দ্বারা তৈরি করা তথ্য, ছবি ও ভিডিও নিয়ে মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারের উদাহরণ দেখা যায়।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা 

ইনভেস্টোপিডিয়া অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হলো মেশিন বা প্রোগামের মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তার অনুকরণ করা। অথবা বলা যেতে পারে মানুষের মত চিন্তা করতে পারে এমন প্রোগ্রামকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। কৃত্তিম উপায়ে এই বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রাম তৈরি করা হয় বলে এমন নাম। এই মেশিন বা প্রোগ্রামগুলো মানুষের মতো চিন্তা করা ও মানুষের কাজের অনুকরণ করার জন্য তৈরি করা হয়। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা যে কোনো মেশিনে প্রয়োগ করা যেতে পারে যা মানুষের মনের সাথে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে। যেমন কোনো কিছু শেখা কিংবা সমস্যা সমাধান করা

দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে

Image: businessinsider

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ.আই দ্বারা তৈরি কন্টেন্ট

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ.আই দ্বারা তৈরি কন্টেন্ট প্রধাণত তিন ধরণের হয়ে থাকে। তিন ধরণের কন্টেন্ট যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়।

  • কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি তথ্য বা টেক্সট কন্টেন্ট
  • কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি ছবি বা ইমেজ কন্টেন্ট
  • কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি ভিডিও বা ভিডিও কন্টেন্ট 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি কন্টেন্ট যাচাই

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার কন্টেন্ট একদম নিশ্চিতভাবে যাচাই করা কঠিন বলা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যে সকল উপায় রয়েছে সেটা থেকে কেবলমাত্র সম্ভাবনার ধারণা নেওয়া যায় যে কন্টেন্টটি এআই জেনারেটেড কিনা। কিন্তু নিশ্চিতভাবে সোর্স দিয়ে তা প্রমাণ করাটা অনেকটা দুরহ কিংবা যায় না বললেই চলে। এসকল ক্ষেত্রে তাই সম্ভাবনার পরিমাপের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার কন্টেন্ট যাচাইয়ের নানাবিধ পদ্ধতি ধীরে ধীরে তৈরি ও আবিষ্কার হচ্ছে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায়না যে এই পদ্ধতিতে তথটি যাচাই করা যাবে। এক্ষেত্রে কেবল সম্ভাব্য কিছু পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই বিষয়টি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সব ধরণের কন্টেন্ট (টেক্সট, ছবি ও ভিডিও) এর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আরো কয়েকটি এ.আই প্রোগ্রাম বা প্ল্যাটফর্ম এর ব্যাপারে জানা যাবে এই ভিডিও প্রতিবেদনে

  • বিভিন্ন এ.আই প্ল্যাটফর্মে তাদের নিজস্ব কন্টেন্ট ডিটেকশন বা শনাক্তকরণ টুলস আছে কিনা তা খোঁজ করে যদি থাকে সেক্ষেত্রে সে টুলস এর সহযোগিতা নিতে হবে। এরকম কিছু টুলস এর বিষয়ে জানা যাবে এই প্রতিবেদন থেকে।
  • ইন্টারনেট থেকে অনুসন্ধান করে বিভিন্ন কন্টেন্ট ডিটেকশন টুলস এর সহযোগীতা নিতে হবে। যদিও এই টুলসগুলো শনাক্তকরণে কতটুকু সফল সেটা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছেনা। এরকম একটি টুলস দেখুন এখানে
  • এ.আই প্রতিষ্ঠানের ইমেইলে যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া যেতে পারে। তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কিংবা যাচাই করতে না পারলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন টপিক-ই কেবল মেইল করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

[ এই পদ্ধতিগুলো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ.আই দ্বারা তৈরি সব ধরণের কন্টেন্ট (টেক্সট, ছবি ও ভিডিও) যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ]

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি তথ্য বা টেক্সট কন্টেন্ট যাচাই

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি টেক্সট কন্টেন্ট যাচাই করার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত চ্যাটজিপিটি কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এ.আই দ্বারা তৈরি টেক্সট শনাক্ত করার জন্য একটি টুলস তৈরি করেছে। এ সম্পর্কে প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট “দ্য ভার্জ” এর প্রতিবেদন দেখুন এখানে

Screenshot: The Verge

সম্ভাব্য আরো যেসব প্রক্রিয়ায় এ.আই দ্বারা তৈরি টেক্সট কন্টেন্ট যাচাই করা যায়ঃ

  • তথ্য সম্পর্কে সাধারণ গুগল বা অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ কিংবা গুগল এডভান্স সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্যটির উৎস কিংবা অন্যান্য কোনো সূত্রপাত সম্পর্কে খুঁজতে হবে।
  • টেক্সট কন্টেন্ট রিলেটেড প্রশ্ন বা ইনপুট টেক্সট সম্পর্কে আইডিয়া করে নিজে নিজেই বিভিন্ন এ.আই প্ল্যাটফর্মে ইনপুট দিয়ে উত্তর এর সাথে টেক্সট মিলিয়ে নেওয়া। যদিও প্রশ্ন না মিললে কিছুটা ভিন্ন উত্তর পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল ধরণের টেক্সট ইনপুট দিয়ে যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে।
  • একই টেক্সট বা তথ্য অন্যান্য অথেনটিক সাইট থেকে পাওয়া যায় কিনা সেটা চেক করে দেখতে হবে। যদি পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে কন্টেন্ট প্রকাশের তারিখ কিংবা প্ল্যাটফর্ম (অথেনটিক সোর্স) অনুযায়ী কোন সাইট থেকে তথ্যটি গ্রহণ করা যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে এ.আই প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেরাই বিভিন্ন সাইট থেকে ডাটা নিয়ে ব্যবহার করে থাকে সেক্ষেত্রে মূল সোর্স থেকে-ই তথ্যটি গ্রহণ করলে এ.আই জেনারেটেড টেক্সট উপেক্ষা করা যেতে পারে।
  •  এ.আই প্ল্যাটফর্মে কোনো ডাটা বা পরিসংখ্যানের ব্যাপারে জানতে চাইলে এ.আই যে উত্তর জানাবে সেটাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ডাটার সাথে ক্রসচেক করে নিতে হবে। কেননা দেখা গেছে যে একই উত্তরের ক্ষেত্রে একটি এ.আই প্ল্যাটফর্ম ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে।
  • এ.আই প্ল্যাটফর্ম এর প্রদর্শিত তথ্য পড়ে দেখা যেতে পারে। যেহেতু এ.আই প্ল্যাটফর্ম কৃত্তিম উপায়ে এটি জেনারেট করে সেহেতু শব্দচয়ন ও বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে মানবসুলভ না হয়ে যান্ত্রিক অনুবাদের মত যান্ত্রিকতা পরিলক্ষিত হতে পারে। মানুষ একটি লেখায় অবচেতনে কিংবা স্বাভাবিকভাবেই একই শব্দের বিভিন্ন প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এ.আই জেনারেটেড কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রে সাধারণত এটি পরিলক্ষিত হয়না।
  • প্লাজারিজম চেকার টুলসগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। অনেক সময় কোনো সাইটের কন্টেন্ট এআই বিভিন্ন জায়গায় সামান্য একটু পরিবর্তন করে উপস্থাপন করে সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে মূল কন্টেন্ট ও এআই দ্বারা তৈরি কন্টেন্ট আলাদা করা যেতে পারে।

গোল্ডেন পেঙ্গুইন ডট ওআরজি নামক একটি সাইট এর এক লেখায় আর কিছু শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১. বাক্যের দৈর্ঘ্য: এ.আই দ্বারা তৈরি কন্টেন্ট-এ প্রায়ই খুব ছোট বাক্য থাকে। এর কারণ হল এ.আই মানুষের লেখার নকল করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এটি এখনও পর্যন্ত ব্যাপক বাক্য জটিলতা আয়ত্ত করতে পারেনি। 

২. শব্দ এবং বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি: এ.আই দ্বারা তৈরি কন্টেন্ট শনাক্ত করার আরেকটি উপায় হল শব্দ এবং বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি খোঁজা। যদি একটি নিবন্ধ পড়ে মনে হয় একই শব্দ বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে, তাহলে এটি এ.আই দ্বারা লেখা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনেক ক্ষেত্রে এ.আই তার কন্টেন্টে একটি শব্দ বা বাক্যাংশ এতবার পুনরাবৃত্তি করে যে এটি অপ্রাকৃত শোনায়।

৩. বিশ্লেষণের অভাব: একটি বিশ্লেষণী নিবন্ধ এআই দ্বারা লেখা হয়েছে কিনা তা বলার তৃতীয় উপায় হল যদি জটিল বিশ্লেষণের অভাব থাকে। এর কারণ হল মেশিনগুলি ডেটা সংগ্রহে ভাল, কিন্তু তারা এটিকে অর্থপূর্ণ কিছুতে পরিণত করতে এখনও এতটা পারদর্শী নয়।

৪. ভুল তথ্য: এআই-জেনারেটেড কন্টেন্টের বিবরণে ভুল তথ্য বেশি দেখা যায। তবে এই ধরণের ভুল ব্লগ পোস্ট এবং নিবন্ধগুলিতেও পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু মেশিনগুলি (এআই প্রোগ্রাম) বিভিন্ন উৎস থেকে ডেটা সংগ্রহ করছে, তারা কখনও কখনও ভুল করে।

৫. সমন্বয়: এআই কন্টেন্টে মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্টতার অভাব থাকতে পারে, বিশেষ করে যখন জটিল কোনো টপিক হয়। অন্যদিকে, মানব-লিখিত পাঠ্য সাধারণত আরো সুসঙ্গত এবং একটি যৌক্তিক কাঠামো অনুসরণ করে লেখা হয়। এআই তৈরি কন্টেন্ট পাঠ করেই অনেক ক্ষেত্রে উপলব্ধি করা যায়।

Screenshot: petapixe

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি ছবি যাচাই

সাধারণ তোলা ছবি এবং এআই জেনারেটেড ছবির মধ্যে দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাই ছবি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সেটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এজন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব ছবি সম্পর্কে সন্দেহ করতে হবে। আবার এআই জেনারেটেড ছবি সন্দেহ হওয়া সব ছবি-ই যে এআই জেনারেডেট হবে তা-ও নিশ্চিত করে বলা যাবেনা। স্কেচ কিংবা আর্ট কিংবা ডিজিটাল আর্টসহ সমজাতীয় অনেক ধরণের কন্টেন্ট হতে পারে। তাই সে বিষয়টিও নিশ্চিত হতে চেষ্টা করতে হবে।

উপরে বর্ণিত সাধারণ (কমন) প্রক্রিয়া যা সব ধরণের এআই কন্টেন্ট যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা ব্যতীত ছবি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিষেষভাবে আরো সম্ভাব্য কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

  • ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এই ছবি সম্পর্কে কোনো তথ্য আগে থেকেই ইন্টারনেটে রয়েছে কিনা সেটা দেখতে হবে।
  • প্রথম পোস্টকারীর কাছ থেকে ছবি সম্পর্কে তথ্য জানতে চাওয়াঃ কোনো ছবিকে এআই জেনারেটেড বলে সন্দেহ হলে সেই ক্যাপশন সহ সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সকল ক্যাপশন বা কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে অথবা রিভার্স সার্চ করে কিংবা যে কোনো উপায়ে ছবিগুলো প্রথম কে কোন মাধ্যমে আপ্লোড করেছে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে। এরপরে সেই আপ্লোডকারীর কাছ থেকে ছবির ব্যাপারে তথ্য জানতে চাইতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সবসময়ই যে তিনি রেসপন্স করবেন এমনটা নিশ্চিত করা যায়না।
  • এআই প্রোগ্রাম দিয়ে ছবি জেনারেট করে এমন প্ল্যাটফর্মগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও হ্যান্ডেলগুলোতে আলোচিত ছবি সম্পর্কে খোঁজ করা যেতে পারে। যদিও অধিকাংশ প্ল্যাটফর্ম এখনও তাদের জেনারেটেড কন্টেন্ট কোথাও আপ্লোড বা সংরক্ষণ করা শুরু করেনি। 
  • প্রাপ্ত ছবিটি দেখে ছবির কন্টেক্সট দেখে যথাসম্ভব সঠিক ইনপুট কি-ওয়ার্ড বা নির্দেশনা তৈরি করে সেই নির্দেশনা বিভিন্ন এআই ইমেজ জেনারেটরে ইনপুট দিয়ে দেখতে হবে। যদি হুবহু এক কিংবা প্রায় একই ধরণের ছবি আউটপুট হিসেবে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে আলোচিত ছবিটিকে এআই জেনারেটেড ছবি হিসেবে ধরা যেতে পারে।
  • সন্দেহজনক যদি কোনো ছবিতে কোনো স্থান সম্পর্কে নতুন কোনো ধারণা কিংবা ঘটনা কিংবা বিষয়ের ইঙ্গিত বহন করে কিন্তু ইন্টারনেটে কিংবা সংবাদমাধ্যমে সেই স্থানের বাস্তবিক চিত্র সেরকমটা না পাওয়া যায় বা সেই ঘটনার সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সেগুলোও এআই জেনারেটেড ছবি হতে পারে। এছাড়াও, একটি স্থানে এমন এক ঘটনার কথা বলা হলো (ছবিতে) যেখানে সেই ঘটনা ঘটা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয় তাহলে তা-ও এআই জেনারেটেড ছবি হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় কোনো স্থাপনা বরফে ঢেকে গেছে এমন ছবি যদি পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে সেটি সম্পর্কে সন্দেহ করা যায়। কেননা সাধারণত বাংলাদেশে বরফ পড়েনা, আবার যদি সেরকম কিছু ঘটে থাকতো তাহলে অবশ্যই গণমাধ্যমে সে বিষয়ে তথ্য থাকতো।
  • অনেক সময় স্কেচ বা বিভিন্ন আঁকা ছবিকে প্রযুক্তির সহায়তায় জীবন্ত এর মতো করা হয় সেগুলো সরাসরি এআই জেনারেটেড না হলেও প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পাদিত ছবি হিসেবে ধরে নিতে হবে। এগুলো শনাক্ত করার ক্ষেত্রে স্কেচ রিলেটেড ক্যাপশন সহ বিভিন্ন উপায়ে সার্চ করে খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। অনুসন্ধানে কোথাও কোনো নাম বা সূত্র পেলে সেই সূত্রের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে।
  • কমেন্ট বক্সে সূত্র বা প্রমাণ সম্পর্কে খোঁজ করাঃ অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এজাতীয় ছবির ক্ষেত্রে ছবি যিনি তৈরি করেছেন তিনি নিজেই সত্যতার বিষয়ে মতামত প্রদান করেন। অথবা যিনি সত্যতা সম্পর্কে জানেন এমন কেউ মতামত করতে পারেন। 
  • প্লাটফর্মগুলোতে যুক্ত হয়ে জেনারেটেড ছবির সংগ্রহ আছে কিনা সেটা যাচাই করা। সংগ্রহ বা ডাটাবেজ থাকলে সেখানে খোঁজার চেষ্টা করা। যেমন মিডজার্নি নামক ছবি জেনারেটর একটি এআই টুলস এর ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার পরে সবার ইনপুট থেকে তৈরি করা ছবিগুলো দেখা যায় (ডিস্কর্ডে)।  
  • ছবিতে ওয়াটারমার্ক খোঁজাঃ কিছু এআই প্ল্যাটফর্ম তাদের দ্বারা তৈরি ছবিতে ওয়াটারমার্ক যুক্ত করে দেয়। আবার অনেক সময় যিনি ইনপুটের মাধ্যমে তৈরি করেন তিনি নিজেও ওয়াটারমার্ক সযুক্ত করে প্রচার করেন। সেক্ষেত্রে এসব এআই জেনারেটেড ছবিতে ওয়াটারমার্ক পাওয়া যায়। সেই ওয়াটারমার্ক এর সূত্র ধরে অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
  • অধিকাংশ ক্ষেত্রে এআই জেনারেটেড ছবিতে বড় ও কাছের বিষয়বস্তু স্পষ্ঠ ও নিখুঁত হলেও ছবির মধ্যে থাকা ছোট ও দূরবর্তী বিষয়বস্তু নিখুঁত ও স্পষ্ট হয়না, ঝাপসা থেকে যায়। এরকম নানবিধ অসংগতি খোঁজ করা যেতে পারে।

এআই এর পাশপাশি হুবহু জীবন্ত কোনো মানুষ কিংবা প্রাণীর ছবি তৈরির একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। একে বলা হয় Generative Adversarial Network বা GAN কন্টেন্ট। এই পদ্ধতিতে প্রধানত হুবহু জীবন্ত মানুষ, বিড়াল, ঘোড়া, আর্টওয়ার্ক, শহর বা এজাতীয় কিছু তৈরি করা হয়। GAN কন্টেন্ট যাচাই করা আরো বেশি কঠিন ও দুরহ।

তবে সময়ের সাথে সাথে এসকল কন্টেন্ট যাচাই করার জন্যও প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন হচ্ছে। GAN কন্টেন্ট যাচাইয়ের এরকম একটি সাইট লিংক পাবেন এখানে। এছাড়াও ইন্টারনেটে এজাতীয় আরো কিছু টুলস পাওয়া যায়। নিশ্চিত কোনো সমাধান না পেলেও এখান থকে অনুসন্ধানে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।

Screenshot: machinelearningmastery

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি ভিডিও যাচাই

মেশিন প্রোগ্রাম বা এআই প্রোগ্রাম-এ নির্দেশনা ইনপুট দিয়ে তৈরি করা ভিডিওকে এআই জেনারেটেড ভিডিও বলে। এমনকি ডিপফেক ভিডিও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে ডিপফেক ভিডিওতে প্রধানত তারকা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির অনুরূপ হিসেবে নকল ভিডিও তৈরি করা হয়ে থাকে। সে কারণে ডিপফেক ভিডিও যাচাই করার প্রক্রিয়াগুলো সাধারণ এআই জেনারেটেড ভিডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সময়ের সাথে সাথে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করার উপায়ও আবিষ্কার হয়েছে। খালি চোখে সাধারণ মানের ডিপফেক ভিডিওগুলো শনাক্ত করা এখনও সম্ভব হতে পারে। অস্বাভাবিক মুখভঙ্গি, চোখের পাতার অস্বাভাবিক নড়াচড়া কিংবা মাথার অস্বাভাবিক গতিবিধি বা নড়াচড়া, অবাস্তব ত্বকের রঙ বা ত্বকের অস্বাভাবিক পরিবর্তন; ঝাঁকুনি, ঠোঁট নড়ার সাথে কথার কম মিল, ব্যাকগ্রাউন্ডের চেয়ে ব্যক্তির মুখ অস্পষ্ট, সাবজেক্টে আলো সমস্যা, ফ্রেমে অতিরিক্ত পিক্সেল ইত্যাদি (তথা ক্রিটিকাল থিংকিং বা যুক্তিনির্ভর চিন্তাশীলতা) দেখে প্রাথমিকভাবে  ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রেই ডিপফেক ভিডিও যাচাই করা যায়। সবার ব্যবহারের জন্য সরাসরি উন্মুক্ত টুলসের ব্যাপারে না জানা গেলেও কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কিছু টুলস রয়েছে যার দ্বারা ডিপফেক শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও শনাক্তের জন্য নতুন নতুন টুলস তৈরির জন্য গবেষণা ও চেষ্টা চলছে।

যদিও অডিও ম্যানিপুলেশন, অর্থ্যাৎ শব্দ নিয়ে কারসাজি’র ব্যাপারেও আলোচনা হচ্ছে তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডিপফেক ভিডিও ফরম্যাটে হয়। তাই ডিপফেক যাচাই করার ক্ষেত্রে ভিডিও থেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বা বিভিন্ন সময়ের ছবি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ টুল ব্যবহার করে যাচাই করা যেতে পারে। ছবির ক্ষেত্রে ফটো মেটাডেটা কিংবা ভিডিও মেটাডেটা টুলস ব্যবহার করা হয়। সাধারন ভিডিওর ক্ষেত্রে ইনভিড (inVid) ও ইউটিউব ভিডিওর ক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর “ইউটিউব ডেটা ভিউয়ার” ব্যবহার করা যেতে পারে।

জার্মানির মিউনিখের ভিজ্যুয়াল কম্পিউটিং ল্যাবের একটি দল তৈরি করেছে ফেস ফরেনসিকস্ টুলস। প্রোগ্রামটি র’-ফরম্যাট (যে ফরম্যাটে ধারন করা) ফাইল থেকে ভিডিওর বিকৃতি সনাক্ত করতে পারে। তবে ওয়েবের জন্য সংকুচিত বা কমপ্রেস করা ভিডিওর বেলায় তারা ফলাফল যাচাই করতে সফল হয়নি

প্রযুক্তি যত উন্নত হয়ে উঠছে এবং ডিপফেক প্রযুক্তিও বা GAN প্রক্রিয়াগুলি আরও উন্নত হয়ে উঠেছে। অদূর ভবিষ্যতে একটি ভিডিও আসল কিনা তা বলা অসম্ভব হয়ে উঠবে।

এ কারণেই ডিপফেকের বিরুদ্ধে এআই-ভিত্তিক পাল্টা ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ চলছে। কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশ অব্যাহত থাকায়, এই পাল্টা ব্যবস্থাগুলোকে গতিশীল রাখতে হবে। সম্প্রতি, ফেসবুক এবং মাইক্রোসফ্ট, অন্যান্য কোম্পানি এবং বিশিষ্ট ইউএস ইউনিভার্সিটিগুলির একটি গুচ্ছের সাথে ডিপফেক ডিটেকশন চ্যালেঞ্জ (DFDC) এর পিছনে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে। এই উদ্যোগটি গবেষকদের  একটি ভিডিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করতে পারে এমন প্রযুক্তি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে। 

এছাড়াও, বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার করেও ডিপফেক শনাক্ত করা সম্ভব। বায়োমেট্রিক্স হল আমাদের শরীরের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। একজন মানুষের বায়োমেট্রিক্স জানলে সেই ব্যক্তিকে সনাক্ত করা সম্ভব। ডিপফেক উন্মোচন করার জন্য বায়োমেট্রিক্স ব্যবহার দুটি প্রক্রিয়ায় হতে পারে, প্রথমত আচরণগত বায়োমেট্রিক্স এবং অন্যটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি বা ফেসিয়াল রিকগনিশন। 

ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে যেসকল বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে সাধারণ এআই জেনারেটেড ভিডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও ভিডিওর বিষয়বস্তু সম্পর্কে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। এছাড়াও,

  • ভিডিওটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে ভিডিওর বিভিন্ন দৃশ্য থেকে স্ক্রিনশট বা ছবি নিয়ে সেই ছবি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে এই ছবি তথা ভিডিও সম্পর্কে কোনো তথ্য আগে থেকেই ইন্টারনেটে রয়েছে কিনা সেটা দেখতে হবে।
  • এআই জেনারেটেড ভিডিও শনাক্তকরণ টুলস সম্পর্কে খোঁজ করা এবং সেগুলোর সহায়তা নেওয়া। এমন টুলস নিয়ে বিজনেস ইনসাইডারের এক প্রতিবেদন দেখুন এখানে
Screenshot: elai.io

এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি আবেদন

এআই প্ল্যাটফর্মগুলো আরো কিছু ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নিলে কিংবা টুলস তৈরি করলে এসকল কন্টেন্ট যাচাই করা আরো সহজ হতো। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে এআই জেনারেটেড ছবি নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখা গেছে। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে এই প্রবণতা আর বৃদ্ধি পাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এআই প্ল্যাটফর্মগুলো যে যে উদ্যোগ নিতে পারেঃ

  • এআই প্ল্যাটফর্মগুলোতে টেক্সট কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রে তা এআই জেনারেটেড কিনা তা যাচাইয়ের অপশন রাখা।
  • এআই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে তৈরিকৃত সকল ছবি বা ভিডিও ডাটাবেজ তাদের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত রাখা কিংবা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অন ডিমান্ড সুবিধা চালু করা।
  • উন্মুক্ত রাখলে তা নিজস্ব সাধারণ সার্চ পদ্ধতি কিংবা রিভার্স ইমেজ সার্চ-এ পাওয়া যাবে এমন ব্যবস্থা করা।
  • অথবা যদি ডাটাবেজ উন্মুক্ত রাখা কিংবা সাধারণ অন ডিমান্ড প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব না হয় তাহলে মেইল কিংবা ইন ওয়েবসাইট টেক্সট পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ভেরিফিকেশন কিংবা আলোচিত ছবি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তথ্য পাওয়ার সুযোগ চালু করা। 
  • অথবা বিশেষ বিবেচনায় শুধুমাত্র ফ্যাক্ট-চেকার ও মিডিয়া প্রফেশনালদের জন্য এই সুযোগগুলো কোনো কোলাব্রেশনের মাধ্যমে চালু করা। অন্তত জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে এমন কন্টেন্টের ক্ষেত্রে যেন ফ্যাক্ট-চেকারগণ তা যাচাই করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে।

সুতরাং, কোনো কন্টেন্ট নিয়ে সন্দেহ হলে তা অবশ্যই যাচাই করে নেওয়া উচিত। সম্ভব হলে সবসময়-ই সব ধরণের কন্টেন্ট যাচাইয়ের পরেই কেবলমাত্র তা শেয়ার করা, বিশ্বাস করা কিংবা মতামত দেওয়া উচিত। বিশেষ করে, গণমাধ্যম কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সব ধরণের কন্টেন্ট অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে। নিজে নিজে তথ্য, ছবি ও ভিডিও যাচাই করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে আমাদের প্রকাশিত নিবন্ধটি দেখতে পাওয়া যাবে এই লিংকে

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img