অপপ্রচারের লক্ষ্যবস্তু তরুণী: ঢাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে গণমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড

মেটার মালিকানাধীন ফেসবুক বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দেশের গণমাধ্যমগুলো সংবাদ প্রচারে ফেসবুকের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্ল্যাটফর্মে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে, ফেসবুক তাদের অ্যালগরিদমে পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে বাহ্যিক লিঙ্ক যুক্ত পোস্টের অর্গানিক রিচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর প্রভাবে, গণমাধ্যমগুলো বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে ফটোকার্ড ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছে। 

২০২৩ সাল থেকে অধিকাংশ গণমাধ্যম ফেসবুকে তাদের অর্গানিক রিচ বাড়ানোর জন্য সংবাদের শিরোনাম দিয়ে ফটোকার্ড তৈরি করে এবং মূল লিঙ্কটি পোস্টের কমেন্টে যোগ করছে। তবে, এই ফটোকার্ডের ব্যবহার অপপ্রচারকারীদের জন্য নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আগে যেখানে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা ছিল, এখন ফটোকার্ড সম্পাদনা করে বা ভুয়া ফটোকার্ড তৈরি করে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

রিউমর স্ক্যানারের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে গণমাধ্যমের ফটোকার্ডকে কেন্দ্র করে কোনো গুজব ছড়ানোর ঘটনা চিহ্নিত হয়নি। তবে এক বছরের ব্যবধানে, ২০২৩ সালে গণমাধ্যমের নাম ব্যবহার করে নকল ও ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে ১০৫টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু ২০২৪ সালের গেল অক্টোবর মাসেই, ভুয়া ও নকল ফটোকার্ড ব্যবহার করে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ৩৭টি ভুল তথ্য প্রচারের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সম্প্রতি, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এক তরুণীকে টার্গেট করে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে গণমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। গত ১৩ নভেম্বর, বুধবার, রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক গ্রুপে ‘Tin Tin’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রথম আলোর নাম ও লোগো ব্যবহার করে তৈরি একটি ফটোকার্ড যাচাইয়ের অনুরোধ আসে। রিউমর স্ক্যানারের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফটোকার্ডটি তখনও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়নি। তবে উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফটোকার্ডটির প্রথম প্রকাশ করা হয়েছে ‘Tin Tin’ নামের ওই অ্যাকাউন্ট থেকেই।

Screenshot: Facebook. 

ফটোকার্ডটিতে ফারিয়া নামের এক তরুণীর নাম ও ছবি ব্যবহার করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, “পেটের ভেতরে ইয়াবা পাচার, চাঁদপুরে ছাত্র-ইউনিয়ন নেত্রী আটক”। এর সাথে প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৩ নভেম্বর। তবে প্রথম আলোর কোনো প্ল্যাটফর্মে ওই তারিখে এমন কোনো ফটোকার্ড প্রকাশের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ছাড়া, ফটোকার্ডটির ফন্ট ও ডিজাইনের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য প্রথম আলোর আসল ফটোকার্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ, এটি একটি ভুয়া ফটোকার্ড।

১৬ নভেম্বর, ‘Tin Tin’ নামের ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আবারও রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক গ্রুপে একটি ফ্যাক্ট-চেক অনুরোধ করা হয়। তবে এবার কোনো গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নয়; এবারের বিষয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহিলা সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থার প্রাথমিক সদস্যপদ ফরম। ফরমটিতে ফারিয়া নামের এক নারীর নাম ও ছবি যুক্ত থাকতে দেখা যায়।

Screenshot: Facebook. 

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবিতে ব্যবহৃত মূল ফরমটি গত ১৪ নভেম্বর ‘Akash Kabir’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রথম প্রচারিত হয়। আকাশ তার পোস্টে অভিযোগ করেন, তার ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট বোনকে দিয়ে ছাত্রীসংস্থার কিছু মেয়ে এই ফরম পূরণ করিয়ে নিয়েছে। আকাশের প্রকাশিত মূল ফরম বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে নাম ছিল ফারহানা কবির, স্বাক্ষরও ছিল তার। তবে মূল ফরমে কোনো ছবি যুক্ত ছিল না।


পরবর্তীতে, ফরমটি বিকৃত করে সেখানে ফারিয়া নাম, তার স্বাক্ষর এবং একটি ছবি প্রযুক্তির সাহায্যে সংযোজন করা হয়। ফরমের তারিখ ও অন্যান্য তথ্য অপরিবর্তিত থাকলেও এই পরিবর্তন উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই বিকৃত ফরমটিও প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Tin Tin’ নামের ফেসবুক আইডি থেকে।

Comparison: Rumor Scanner.


সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর, ‘Tin Tin’ নামের ফেসবুক আইডি থেকে আবারও ফারিয়ার নাম ও ছবি ব্যবহার করে একটি ফটোকার্ড প্রচার করা হয়। ফটোকার্ডটিতে ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির নাম ও লোগো ব্যবহার করে শিরোনাম দেওয়া হয়, “সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন চাঁদপুর জেলার সমন্বয়ক ফারিয়া” এবং এতে গত ১৬ নভেম্বরের তারিখ রয়েছে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই তারিখে ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির কোনো প্ল্যাটফর্মে এমন ফটোকার্ড প্রকাশের কোনো প্রমাণ মেলেনি। অর্থাৎ, এটিও একটি ভুয়া ফটোকার্ড। এই ভুয়া ফটোকার্ডটির উৎসও ‘Tin Tin’ আইডি, যা পরবর্তীতে সামাজিক মাধ্যমে সত্য ভেবে ভাইরাল (,,) হতে দেখা যায়।

Collage: Rumor Scanner.

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ফারিয়া নামের একই তরুণীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। প্রথমে, প্রথম আলোর ফটোকার্ড ব্যবহার করে তাকে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী এবং মাদক পাচারকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এরপর, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রীসংস্থার প্রাথমিক সদস্য ফরমে তার নাম ও ছবি জুড়ে দিয়ে তাকে জামায়াত-সমর্থিত বলে প্রচার করা হয়। সর্বশেষ, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির লোগো ব্যবহার করে তাকে চাঁদপুর জেলার সমন্বয়ক উল্লেখ করে তার মৃত্যু নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে যে, ফারিয়াকে জড়িয়ে এই ভুয়া প্রচারণার মূলে রয়েছে ‘Tin Tin’ নামের ফেসবুক আইডি। অ্যাকাউন্টের অ্যাবাউট সেকশনে এর ব্যবহারকারীর অবস্থান কানাডা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

লাগাতার এমন অপপ্রচারের শিকার ফারিয়া হোসেন রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “জুলাই – আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আমি আমার সাধ্যমতো অ্যাক্টিভ থেকে আমার ছাত্র ভাইবোন বা বন্ধুদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি৷ আন্দোলনের প্রায় পুরোটা সময়েই আমি ঢাকায় অবস্থান করে আন্দোলনের অ্যাক্টিভিটি করেছি৷ স্বাধীনতা অর্জনের পরে, কিছুদিন আগে উপদেষ্টা ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ভাইকে নিয়ে কন্ট্রোভার্সি হওয়ার পরে উনার প্রশংসা করে একটি পোস্ট দেই৷ এবং সেটি দ্রুত ভাইরাল হতে থাকে৷ আর একটি পক্ষ এতে এসে হাহা রিয়েক্ট দিতে থাকি৷ দুদিন পর থেকেই একটি আইডি থেকে আমার নামে এই ধরনের অপপ্রচার চালানো শুরু হয়৷ আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার জন্য এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে৷ আমি জীবিত সুস্থ এবং নিজের যথাযথ জায়গায় আছি। এসব গুজবে কান না দেওয়ার জন্য সকলের কাছে অনুরোধ রইলো৷ শীঘ্রই আমি এই বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেবো৷”

তথ্যসূত্র

Rumor Scanner’s analysis.
Prothom Alo: Facebook Page
Independent Television: Facebook Page
Akash Kabir: Facebook Post
Statement from Faria Hossain.

আরও পড়ুন

spot_img