মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় কথিত মিরসাদ-এর মৃত্যু নিয়ে ছড়িয়ে পড়া দাবিগুলো বানোয়াট

গত ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধ (প্রশিক্ষণ) বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পর একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একের পর এক পোস্ট করা হয় ‘মিরসাদ’ নামের এক শিশুকে নিয়ে। পোস্টদাতা (Aminul Montasir) নিজেকে শিশুটির নানা বাড়ির এলাকার দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দেন। মিরসাদকে নিয়ে বেশকিছু আবেগঘন পোস্ট দিলেও মিরসাদের কোনো ছবি প্রকাশ করা হয়নি।

প্রথমদিকে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্টে লেখা হয়, “আমার ছোট ভাই আর নাই, ক্লাস ১ এর একটা উড়ন্ত রাজা ছিল আমার এই ভাই। লাশ ঝলসে গেছে, বেঞ্চের মধ্যেই ঝলসে গেছে, পাশে আছে নাকি শুধু স্কুলব্যাগটা…” একই পোস্টে দাবি করা হয়, শিশুটিকে মাইলস্টোন স্কুলে ভর্তি করার পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন। পোস্টদাতা লেখেন, “আমিই বলছিলাম ওর আব্বুকে মাইলস্টোন স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য… আমি আর আমার মধ্যে নাই।”

পরবর্তী এক পোস্টে তিনি কথিত মিরসাদের বোনের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করেন এবং লেখেন, “খালামণি লাইফ সাপোর্টে, আমার ছোট ভাই মিরসাদের আম্মু। আঙ্কেল জরুরি কাজে ২ দিন আগে ইতালি গেছে। মিরসাদের শোকে আমার খালা এখন আইসিইউতে ভর্তি। সবাই দোয়া করবেন।”

২২ জুলাইয়ের একটি পোস্টে দাবি করা হয়, ছেলের শোকে মিরসাদের মা মারা গেছেন। পোস্টে লেখা হয়, “২২ জুলাই ৮:৩০ মিনিটে মিরসাদের মা ইন্তেকাল করেছেন। রাত ৭:৩০ মিনিটে আন্টির সেন্স আসছিল, ডাক্তারকে নাকি বলছে আমার ছেলের বডি লাগবে না, আমারে ওর জাস্ট একটা হাড্ডি এনে দেন…” একই পোস্টে মিরসাদের বাবার বয়স ৫৫ বছর উল্লেখ করে বলা হয়, তাকে এখনো মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। তবে এদিকে মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় জেরে ছেলের মৃত্যু শোকে মা মারা গেছেন এমন কোনো ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।

২৩ জুলাইয়ের আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, “আমার ভাই মিরসাদের লাশ শনাক্ত হইছে…” সেখানে লাশের পোশাক ও অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। দাবি করা হয়, স্কুল কমিউনিটি থেকে কল দিয়ে বলা হয়েছিল— ‘অন্তত একবার দেখে যান কোনো অংশ চিনতে পারেন কিনা’। এরপর মিরসাদের মামা ও নানা এসে লাশ শনাক্ত করেন। আগের পোস্টে মিরসাদের মা মারা গেছেন দাবি করা হলেও, এ পোস্টে বলা হয় তার ডিএনএ স্যাম্পল তিনি জীবিত থাকার সময়ই নিয়ে রাখা হয়েছিল, যার মাধ্যমে লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। 

২৪ জুলাই প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে থেকে জানা যায়, ঘটনার পর থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত পাঁচটি পরিবারের ১১ সদস্যের তথ্য বিশ্লেষণ করে মোট পাঁচটি মৃতদেহের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে, তবে তাদের সেই তালিকায় মিরসাদ নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। 

পোস্টদাতা একের পর এক আবেগঘন পোস্ট দিলেও, কথিত মিরসাদের বোন, বাবা, মামা বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের তরফ থেকে কোনো পোস্ট বা বক্তব্য দেখা যায়নি। যদিও, ওই পোস্টদাতার এক বন্ধু বিষয়টি নিয়ে আরেকটি পোস্ট করেছিলেন।

মিরসাদের খোঁজে রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধান

কথিত মিরসাদকে ঘিরে পোস্টদাতার দাবির অসঙ্গতি বিশ্লেষণ করে, অনেকেই এ বিষয়টির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন। কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে, তাদের উদ্দেশ্যে আরও বিভিন্ন গল্প দিয়ে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রিউমার স্ক্যানারের কাছেও বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হয়।

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃক প্রকাশিত আহত ও নিহতদের তালিকা, আইএসপিআর– এর ফেসবুক পেজ এবং প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে প্রকাশিত আহত ও নিহতদের কোনো তালিকাতেই  ‘মিরসাদ’ নামের কোনো শিক্ষার্থীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত পাঁচজন নিহতের মধ্যেও মিরসাদ বা এরশাদ নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। এ সব তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা নিশ্চিত হই, ‘মিরসাদ’ নামের শিশু সংক্রান্ত গল্পটি বানোয়াট।

পরবর্তীতে, ২৭ জুলাই আমাদের পক্ষ থেকে সেই পোস্টদাতা Aminul Montasir-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে তার কাছে মিরসাদের পুরো নাম, বাবার নাম ও বাবার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম জানতে চাওয়া হয়। তবে তিনি আমাদের মেসেজের কোনো উত্তর দেননি। পরবর্তীতে তার একটি পোস্টের মন্তব্যেও একই অনুরোধ করা হলে, সেখানেও তিনি কোনো উত্তর দেননি আমরা তার উত্তর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি।

এদিকে, যোগাযোগের পর দেখা যায়— তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে মিরসাদ সংক্রান্ত সব পোস্ট সরানো বা প্রাইভেসি বদলে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। ২৯ জুলাই রাতে (২৮ জুলাই দিবাগত রাতে) একটি পোস্টে তিনি লেখেন: “আমি নিজ থেকে এই বিষয় বলতেছি যে, সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা, অহেতুক তথ্য আমি যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছি… আবেগের বশবর্তী হয়ে, কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই এই পোস্ট করার জন্য অবশ্যই আমি আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় হওয়ার যোগ্য।” তবে একই পোস্টে কিছু বক্তব্য ছিল যা তার ক্ষমা চাওয়ার ভাষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অস্পষ্ট ছিল। একই দিনে তিনি আমাদের মেসেজের রিপ্লাই দেন, সে সময় তার কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করে বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি আর কোনো রিপ্লাই দেননি। লোকজনের সমালোচনা ও ট্রলের পর, ক্ষমা চাওয়া পোস্টটিও তিনি সরিয়ে ফেলেন।

ফলে, পোস্টদাতার দাবি অনুযায়ী — মিরসাদের মৃত্যু, তার মায়ের আইসিইউতে ভর্তি, কথিত বোনের ইনস্টাগ্রাম চ্যাট, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ডিলিটের ঘটনা, মায়ের মৃত্যুর সংবাদ — সবই ভিত্তিহীন।

এছাড়াও, তিনি নিজেকে এবং কথিত ‘মাইশা’কে এইচএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে উপস্থাপন করে একাধিক পোস্টে এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানান। ফলে ধারণা করা যায়, ‘মিরসাদ’কে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা এই বানোয়াট গল্প আবেগ কুড়িয়ে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টার পাশাপশি এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তনের দাবির পক্ষে জনমত সৃষ্টিতেও ব্যবহার করা হয়েছে।

সুতরাং, মাইলস্টোন বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘মিরসাদ’কে ঘিরে প্রচারিত পোস্টগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট।

তথ্যসূত্র 

  • Rumor Scanner’s Investigation 
  • Aminul Montasir’s posts

আরও পড়ুন

spot_img