সময়ের সাথে সাথে সারা বিশ্বেই বেড়েছে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও ব্যবহার। একই সাথে সমান্তরালে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের-ও ব্যবহার। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ফিচার, বদলাচ্ছে কন্টেন্টের ধরণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদনের ক্ষেত্রে কন্টেন্টের নতুন একটি ধরণ যুক্ত হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে মিম’স।
মিম (Meme) কী?
Merriam-webster dictionary অনুযায়ী, মিম হলো একটি মজাদার বা আকর্ষণীয় কন্টেন্ট (যেমন একটি ক্যাপশন ছবি বা ভিডিও) বা এমন ধরণের কন্টেন্ট যা অনলাইনে বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, মিম হল অনুকরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সাংস্কৃতিক (বিনোদন বিষয়ক) তথ্যের একটি ধরণ। মিম কন্টেন্ট সমূহকে একসাথে বহুবাচকে মিম’স বলা হয়।
মিম’স এর ইতিহাস
মিম শব্দটি (গ্রীক শব্দ mimema থেকে, যার অর্থ “অনুকরণ করা”) ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার রচনা দ্য সেলফিশ জিন বইয়ের মাধ্যমে প্রবর্তন করেছিলেন। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস আরও একটি তথ্য জানিয়েছে যে, “XWordInfo অনুসারে, ১৯৪০-এর দশকে ধাঁধা শুরু হওয়ার পর থেকে ‘মেম’ শব্দটি নিউ ইয়র্ক টাইমস ক্রসওয়ার্ডে ৬০ বার ব্যবহার করা হয়েছে।”
প্রফেসর কনরড বলেছেন, মানুষ যতদিন কোনো প্রতীকী ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে ততদিন যোগাযোগের জন্য মিম’স ব্যবহার করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, “মিমস ইন্টারনেট দিয়ে শুরু হয়নি। কিছু ভাষাবিদ যুক্তি দেন যে মানুষ বহু শতাব্দী ধরে যোগাযোগের জন্য মিম ব্যবহার করেছে (তবে ইন্টারনেটে এখন মিম’স খুব ভালোভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে)। এটি ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক কথোপকথন এবং ইন্টারনেটে চলমান ট্রেন্ডে অংশগ্রহণের একটি মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এমনকি আপনি খুব বেশি অনলাইনে না থাকলেও, আপনি সম্ভবত জেনে বা না জেনে একটি মিম ট্রেন্ডে অংশগ্রহণ করেছেন।”
২১ শতকের গোড়ার দিকে, ইন্টারনেট মিমস বা মিমস যা ইন্টারনেটের সংস্কৃতিতে আবির্ভূত হয়, একইসাথে জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ব্যবহারকারীদের মাঝে মিম ধারণার প্রতি নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়। ইন্টারনেট মিমস অনুকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে, সাধারণত ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ধরনের ওয়েব সাইটের মাধ্যমে। ইন্টারনেট মিম’স সাধারণত বিভিন্ন ধরণের কন্টেন্ট থেকে ব্যক্তি দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করা তৈরি করা হয়। তবে তাদের ইচ্ছাকৃত পরিবর্তন ডকিন্সের মিম’স এর মূল ধারণাকে লঙ্ঘন করে, এবং সেই কারণে অন্যান্য ধরণের মিম’স এর সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তিত হওয়া মিম’স এর মৌলিক মিল থাকা সত্ত্বেও, ইন্টারনেট মিম গুলিকে ডকিন্স এবং অন্যান্য কিছু পণ্ডিতরা মিম’স ধারণার একটি ভিন্ন উপস্থাপনা বলে মনে করেন।
মিম’স থেকে যেভাবে ভুলতথ্য ছড়ায়
মিম’স কন্টেন্ট সত্য কিংবা মিথ্যা উভয়ই হতে পারে। সাধারণত মিথ্যা বা বানোয়াট তথ্য দিয়ে প্রচারিত মিম’স এর ক্ষেত্রে বৈচিত্রতা বেশি থাকায় ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয়তা-ও বেশি দেখা যায়। ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীরা সত্য ও মিথ্যা উভয় ধরণের তথ্যসম্বলিত মিম’স থেকে আনন্দ পায় এবং মিম’স হিসেবেই শেয়ার করে। তবে সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনেকেই মিম’স সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। কিংবা যে ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মিম’স-টি তৈরি করা হয়েছে তারা সে ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়। এমন ক্ষেত্রে নিছক মজার ছলে মিথ্যা তথ্য বা ভুল দ্বারা কিংবা ঘটনাকে বাড়িয়ে বলে তৈরি করা মিম’সকে সাধারণ ব্যবহারকারীরা সত্য ভেবে বসতে পারেন (যারা মিম’স সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, কিংবা যে ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মিম’স-টি তৈরি করা হয়েছে তারা সে ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়)।
এরপরে সত্য ভেবে সেই হিসেবে ক্যাপশন সহকারে কিংবা ক্যাপশন ছাড়াই সত্য দাবির অভিব্যক্তিতে শেয়ার করতে পারে। কেননা তিনি মিম’স এর বিষয়বস্তুকে সত্য হিসেবেই ধরে নিয়েছেন। এমন করেই মিম’স কন্টেন্ট অনলাইনে ভুলভাবে ভুল উপস্থাপনায় ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়াকে আমরা মিসইনফরমেশন বলতে পারি। অধিকাংশ মিম’স-ই মিসইনফরমেশন, কেননা যারা বৃহৎ পরিসরে ছড়ায় তারা সত্যতা না জেনেই ছড়ায়।
তবে মিম’স ডিসইনফরমেশনও হতে পারে। যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে তথ্যকে অতিরঞ্জিত করে মিম’স তৈরি করে তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ডিসইনফরমেশন। আবার যারা মিম’স ও তার প্রেক্ষাপট ও আসল তথ্য জেনেও অতিরঞ্জিত করা মিম’স শেয়ার করে তারা ডিসনফরমেশন ছড়ায়। অর্থাৎ জেনেবুঝে মিথ্যা তথ্য (মিসইনফরমেশন) ছড়ালে তাকে ডিসইনফরমেশন বলা হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মিম’স এ মাধ্যমে ডিসইনফরমেশন ছড়ানোর উদাহরণ তুলনামূলক বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় মিম’স থেকে ভুলতথ্য ছড়ানো কয়েকটি উদাহরণ
(ক) গত ১৯শে সেপ্টেম্বরে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ-এ বাংলাদেশের মেয়েরা বিজয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির বক্তব্য দাবিতে একটা সার্কাজম পোস্ট বা মিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এই মিম’কে (হাস্য রসাত্মক হিসেবে তৈরিকৃত বক্তব্য) সত্য হিসেবে মনে করে অনেক সাংবাদিক, বিনোদন ক্ষেত্রের তারকা এবং খেলোয়াড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন।
এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেরিফায়েড প্রোফাইল থেকেও বিভিন্ন ক্ষেত্রের ইনফ্লুয়েন্সার এবং সাধারণ ব্যবহারকারীগণও পোস্ট করা হয়েছিল।
এমনকি এই বিষয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ-ও প্রকাশ করেছে এবং সেই সংবাদে দেশের একজন আইনজীবী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সার মিমকে সত্য হিসেবে মনে করে তার প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাফুফে সভাপতি এরকম কোনো বক্তব্য দেননি। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
(খ) বিভিন্ন সময় “জাপান এ মৃত ব্যক্তিদের কবরে বসানো হয়েছে কিউ আর স্ক্যানিং কোড যেটা স্ক্যান করলে জানতে পারবেন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কিত বেঁচে থাকতে সময়ের সকল তথ্য” শীর্ষক দাবিতে ছবিসহ একটি তথ্য প্রচার করা হয়।
দাবির সাথে সংযুক্ত ছবিদুটির একটি ছবির বিভিন্ন সংস্করণ বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেটে মিম হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল।
ছবিটির আরও কিছু সংস্করণ দেখুন,
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোনো সমাধির সাথে এরকম কিআর কোড যুক্ত করা হয়নি। বরং চীনের থিমপার্কের স্মৃতিস্তম্ভের কিআর কোড আলোচিত মিম কন্টেন্টের সাথে সংযুক্ত (প্রযুক্তির সহায়তায় এডিট করে) করে প্রচার করা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
মিম কন্টেন্ট যাচাই করার উপায়
এখন পর্যন্ত সিংহভাগ মিম কন্টেন্ট ইমেজ হিসেবে ছড়ায় এবং ছবিতে উল্লিখিত কেবলমাত্র তথ্যটাই যাচাইযোগ্য। অর্থাৎ মিম কন্টেন্ট এর ছবি যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা এখন পর্যন্ত খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না।
যে কোনো মিম কন্টেন্ট এর তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাইয়ের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে তথ্যটি সম্পর্কে গুগলসহ বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ করে অথেনটিক সোর্স থেকে সেই তথ্য সম্পর্কে ক্রসচেক করা বা মিলিয়ে নেয়া। তবে সবসময় সাধারণ সার্চে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া যায়না কিংবা কাঙ্খিত ফলাফল পর্যন্ত পৌঁছানো যায়না। সেক্ষেত্রে এডভান্স সার্চ টেকনিক (প্রধানত গুগল এডভান্স সার্চ) টেকনিক ব্যবহার করে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
গুগলে সার্চ করলে গুগল গ্রহণযোগ্য সোর্স থেকেই তথ্য দেখানোর চেষ্টা করে কিন্তু তথ্যের ধরণ কিংবা বিভিন্ন কারণে অগ্রহণযোগ্য সোর্স থেকেও তথ্য দেখানোর সম্ভাবনা থেকে যায়। তবুও অথেনটিক নয় এমন সোর্স থেকে তথ্য না পেতে চাইলে সোর্সের গ্রহনযোগ্যতাও যাচাই করতে হবে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যাবে।
গুগল এডভান্স সার্চ
যেকোনো তথ্য খুঁজে পেতে আমরা সবাই সাধারণত গুগল সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে থাকি। সার্চের কাজে আমরা গুগল ব্যবহার করলেও অনেকেই জানিনা গুগলে অ্যাডভান্স পদ্ধতিতে সার্চ করা যায়। গুগলের অ্যাডভান্স সার্চ করার আলাদা একটি পেজ রয়েছে। অ্যাডভান্স সার্চ পেজটিতে গিয়ে অ্যাডভান্স পদ্ধতিতে সার্চ করা সম্ভব। পাশাপাশি, বিভিন্ন অপারেটর (গুগল ডর্কিং) ব্যবহার করে মূল পেজ থেকেও অ্যাডভান্স পদ্ধতিতে সার্চ করা যায়।
কোনো তথ্য সম্পর্কে গণমাধ্যমে বা সংবাদমাধ্যমে কী উল্লেখ আছে তা জানার পদ্ধতি
কোনো তথ্য সম্পর্কে কি-ওয়ার্ড দিয়ে গুগলে সার্চ করে ক্যাটাগরি থেকে “News” এ ক্লিক করলে সেই তথ্য সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। গণমাধ্যম থেকে পুরো প্রতিবেদন পড়ে কাঙ্খিত তথ্যের সাথে মিলিয়ে নিতে হবে।
তথ্যের পাশপাশি ছবি ও ভিডিও ফরম্যাটে-ও মিমস ছড়াতে পারে, যদিও এই দুই ফরম্যাট এখনও খুব একটা ব্যবহৃত হয়না। সেক্ষেত্রে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ও এডভান্স কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও যাচাই করে মিম কন্টেন্টের সত্যার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে আরো জানতে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদনের ক্ষেত্রে কন্টেন্টের নতুন একটি ধরণ যুক্ত হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে মিম’স। মিম হলো একটি মজাদার বা আকর্ষণীয় কন্টেন্ট (যেমন একটি ক্যাপশন ছবি বা ভিডিও) বা এমন ধরণের কন্টেন্ট যা অনলাইনে বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মিম শব্দটি (গ্রীক শব্দ mimema থেকে, যার অর্থ “অনুকরণ করা”) ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার রচনা দ্য সেলফিশ জিন বইয়ের মাধ্যমে প্রবর্তন করেছিলেন। সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনেকেই মিম’স সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। কিংবা যে ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মিম’স-টি তৈরি করা হয়েছে তারা সে ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়। এমন ক্ষেত্রে নিছক মজার ছলে মিথ্যা তথ্য বা ভুল দ্বারা কিংবা ঘটনাকে বাড়িয়ে বলে তৈরি করা মিম’সকে সাধারণ ব্যবহারকারীরা সত্য ভেবে বসতে পারেন (যারা মিম’স সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, কিংবা যে ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মিম’স-টি তৈরি করা হয়েছে তারা সে ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়)। এরপরে সত্য ভেবে সেই হিসেবে ক্যাপশন সহকারে কিংবা ক্যাপশন ছাড়াই সত্য দাবির অভিব্যক্তিতে শেয়ার করতে পারে। এভাবেই মিম’স থেকে ভুলতথ্য ছড়ায়।
তথ্যসূত্র
- Merriam-webster- Meme Definition & Meaning
- Britannica- Meme | Definition, Meaning, History, & Facts
- Nytimes- What Is a Meme? The Meaning and History