ঈদে ইসলামিক পতাকা উত্তোলনের আদেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন

সম্প্রতি, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন নিয়ে সুনির্দিষ্ট একটি দাবি ফেসবুকে ছড়াতে দেখা যায়।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাধারণ শাখা থেকে প্রকাশিত কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি মূলত ঈদুল আযহা উদযাপন বিষয়ে নির্দেশনা। কার্যবিবরণীর ০২ নং ক্রমে লেখা রয়েছে, ঈদের দিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে যথাযথ মর্যাদায় সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ও ইসলামিক পতাকা উত্তোলন করতে হবে৷ 

মূলত, ইসলামিক পতাকা উত্তোলন শীর্ষক তথ্য সম্বলিত এই কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন নিয়েই আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে ফেসবুকে। 

এ বিষয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

পতাকা

রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক গ্রুপে একাধিক ব্যক্তি এ কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটির সত্যতা যাচাইয়ের অনুরোধ করেছেন। 

প্রজ্ঞাপনটি বিশ্লেষণ করে যা জানা যাচ্ছে 

রিউমর স্ক্যানার টিম কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনের ছবিটি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, এটি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাধারণ শাখা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কার্যবিবরণীতে উল্লিখিত তথ্য বলছে, ঈদুল আযহা উদযাপন উপলক্ষ্যে জেলা পর্যায়ের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে গত ০৪ জুন একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। 

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এই সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে জেলা পর্যায়ে বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সিদ্ধান্ত হয় বলে জানানো হয় উক্ত নোটিশে। 

নোটিশটির ০২ নং ক্রমে দেখা যাচ্ছে, ঈদের দিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে যথাযথ মর্যাদায় সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ও ইসলামিক পতাকা উত্তোলন করতে হবে৷ 

Screenshot source: Facebook 

কার্যবিবরণী সম্বলিত প্রজ্ঞাপনটির উপরের ডান কোণায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের একটি সিল রয়েছে যাতে একটি স্বাক্ষরও দেখা যাচ্ছে এবং স্বাক্ষরের তারিখ উল্লেখ রয়েছে ১২ জুন। 

তাছাড়া, সিলটির নিচে ‘নিশ্চিতকরণ, পতাকা উত্তোলন’ শীর্ষক হাতে লেখা দুইটি বাক্যও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।  

কবে থেকে ছড়াচ্ছে এই প্রজ্ঞাপন?

রিউমর স্ক্যানার টিম ভাইরাল প্রজ্ঞাপনটির উৎস অনুসন্ধানে একাধিক ফেসবুক মনিটরিং টুলস এবং ম্যানুয়াল সার্চের মাধ্যমে যাচাই করে দেখতে পায়, এই প্রজ্ঞাপনটির দুইটি সংস্করণ ফেসবুকে ছড়িয়েছে। একটি পিডিএফ সদৃশ স্ক্যান কপি। আরেকটি মোবাইলে ধারণকৃতঅই ছবি। 

অনুসন্ধানে গত ২৪ জুন রাত ০১ টা ২১ মিনিটে এ বিষয়ে একটি পাবলিক পোস্টে মোবাইলে তোলা ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

Screenshot source: Facebook 

পিডিএফ স্ক্যান কপিটি একইদিন সকাল ৬ টা ৫৩ মিনিটে ফেসবুকের একটি পাবলিক পোস্টে খুঁজে পাওয়া যায়৷ দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot source: Facebook 

দুই পোস্টেই উল্লিখিত প্রজ্ঞাপনে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। 

অর্থাৎ, একই কার্যবিবরণী দুইটি আলাদা সংস্করণে ছড়িয়েছে। 

অনুসন্ধানে যা জানা গেল

রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে মূলধারার গণমাধ্যম ‘বাংলা ট্রিবিউন’ এর ওয়েবসাইটে গতকাল (২৫ জুন) রাতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারে, আলোচিত সভাটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১২ জুন এই আদেশ (কার্যবিবরণী) জারি করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল জেলা প্রশাসন।

বাংলা ট্রিবিউন জানাচ্ছে, ‘তবে এমন আদেশ জারি হওয়ার পর সমালোচনার মুখে শনিবার (২৪ জুন) এই আদেশ সংশোধন করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জেলা প্রশাসন।’

বাংলা ট্রিবিউনে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, এ বিষয়ে জানতে বাংলা ট্রিবিউন এর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল আমিন সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘ইসলামিক পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি প্রিন্টিং মিসটেক। ভুল করে ছাপানো হয়েছে। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর সংশোধন করে পুনরায় প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।’

Screenshot source: Bangla Tribune  

এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে ফেসবুকে Positive Expression নামক একটি পেজে প্রকাশিত একটি অডিও রেকর্ডে আলোচিত ঘটনায় সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈনের সাক্ষাৎকার (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot source: Facebook 

জনাব মঈন জানান (৩:৪০ মিনিট থেকে), “এটা হচ্ছে ঈদগাহ কমিটির সভা। এটা ড্রাফট করে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে আমরা ঠিক করে দেই। অনেক সময় একসাথে অনেক ফাইল আসলে দেখা হয় না। এরকম একটা কারণে হয়েছে। পরবর্তীতে আমাদের চোখে পড়ার পরপরই আমরা এটা চেঞ্জ করে দিয়েছি। আর উনারা আসলে এটা মিন করে লেখেননি। উনারা আসলে বুঝাতে চেয়েছেন, ঈদ মোবারক লেখা পতাকাকে উনারা ভাবসেন এটা ইসলামিক পতাকা। আর কিছু না।”

প্রশ্নকারির এক প্রশ্নের জবাবে জনাব মঈন দাবি (৫:২০ মিনিট থেকে) করেন, সভায় এমন কোনো সিদ্ধান্তও হয় নাই। সভায় বলা হয়েছে, ঈদগাহ মাঠ জাতীয় পতাকা এবং ঈদ মোবারক লেখা পতাকা দিয়ে সজ্জিত করার বিষয়টা। এটা হচ্ছে সভার সিদ্ধান্ত। ঈদগাহ কমিটির যিনি ড্রাফট করেছেন তিনি ভুলে ঈদ মোবারক লেখা পতাকাকে ইসলামিক পতাকা ভেবেছেন।”

এ বিষয়ে জানতে আমরা Positive Expression পেজটির এডমিনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের জানান, তিনি প্রথমে জেলা প্রশাসককে ফোন করেন এ বিষয়ে। তবে তার ফোন ধরেন জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত সহকারি পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি। তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। পরবর্তীতে তিনিই পরামর্শ দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈনের সাথে কথা বলার। 

পেজের এডমিন পরবর্তীতে জনাব মঈনের সাথে কথা বলেন। 

পেজটির এডমিন রিউমর স্ক্যানারের কাছে উক্ত দুইটি কল রেকর্ড পাঠিয়েছেন যা রিউমর স্ক্যানার টিমের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।  

অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে, বাংলা ট্রিবিউনকে জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, ইসলামিক পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি রেখেই প্রজ্ঞাপন জারির পর আলোচিত বিষয়টি সংশোধন করে পুনরায় প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈনের দাবি, এটা ড্রাফট করার পর সংশোধন করা হয়।

অর্থাৎ, একই প্রতিষ্ঠান থেকেই একই বিষয়ে ভিন্ন মত পাওয়া যাচ্ছে। 

বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধিত শীর্ষক প্রমাণের খোঁজে  

এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে গত ২৪ জুন দুপুর ৩ টা ২৩ মিনিটে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) ঈদুল আযহার কর্মসূচির একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত ছবিতে একই প্রজ্ঞাপন সদৃশ বিষয়বস্তু দেখা গেলেও ০২ নং ক্রমে শুধু জাতীয় পতাকা উত্তোলন শীর্ষক বাক্যই উল্লেখ পাওয়া যায়। 

Screenshot source: Facebook 

তবে, রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। 

আলোচিত প্রজ্ঞাপনটিতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ের সিল এবং স্বাক্ষর রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে তাই অনুসন্ধান করে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা-তুজ-জোহরার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে গত ২৪ জুন সন্ধ্যা ৬ টা ৪৯ মিনিটে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) ঈদুল আযহার কর্মসূচি সম্বলিত বিজ্ঞপ্তির দুইটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই বিজ্ঞপ্তিটিতেও ০২ নং ক্রমে শুধু জাতীয় পতাকা উত্তোলন শীর্ষক বাক্যই উল্লেখ পাওয়া যায়। 

তবে উক্ত ছবিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ছবিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বিজ্ঞপ্তির শুরুতেই লেখা রয়েছে, “একই তারিখ ও স্মারকে প্রতিস্থাপিত।”

Screenshot source: Facebook 

অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাই আমরা যেখানে বিজ্ঞপ্তির শুরুতে একই বাক্য লেখা রয়েছে। 

Screenshot source: Chittagong District Website  

রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে এই ধরনের নোটিশের সাথে সংশ্লিষ্ট বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে, পূর্বের বিজ্ঞপ্তিতে কোনো সংশোধন থাকলে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে উক্ত বাক্যটি লেখা হয়৷ 

অর্থাৎ, আলোচিত বিজ্ঞপ্তিটি জারি করেছিল জেলা প্রশাসন। যা পরবর্তীতে সংশোধন করে নতুন করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

অনুসন্ধান চলাকালে ফেসবুকের একটি পোস্টে (আর্কাইভ) একই সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পেয়েছি আমরা যেখানে সংশোধন সংশ্লিষ্ট উপরোক্ত বাক্যটি না থাকলেও ‘সংশোধিত’ শব্দটি উল্লেখ ছিল। 

Image source: Facebook 

রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে জানতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা-তুজ- জোহরাকে ফোন করলেও তিনি কথা বুঝতে পারছেন না বলে কেটে দেন। পরবর্তীতে হোয়াটসঅ্যাপে তাকে প্রশ্ন পাঠালে তিনি জেলা প্রশাসকের ফেসবুক প্রোফাইলে প্রকাশিত ছবিটি আমাদের কাছে পাঠান। কিন্তু আমরা তার কার্যালয়ের সিল সম্বলিত বিজ্ঞপ্তিটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাদের মেসেজ দেখেও কোনো উত্তর দেননি৷ 

আমরা এ বিষয়ে জানার জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল আমিন এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈনের সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কেউই উত্তর দেননি। 

অর্থাৎ, সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন নিয়ে সুনির্দিষ্ট একটি দাবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রজ্ঞাপনটিতে উল্লেখ করা ছিল যে, ঈদের দিন জাতীয় পতাকা ও ইসলামিক পতাকা উত্তোলন করতে হবে। রিউমর স্ক্যানারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসনের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিটি সত্য এবং আলোচিত প্রজ্ঞাপনে এই বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে এবং সেখানে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ের সিল এবং স্বাক্ষরও রয়েছে। তবে পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপনটি সংশোধন করে ইসলামিক পতাকা উত্তোলন বিষয়ক শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img