ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাই করলে গরু ও অন্যান্য পশুর ব্যথা অনুভব করার বিষয়ে যা বলছে গবেষণা

আর মাত্র কয়েকদিন পরই উদযাপিত হতে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল আজহা। আর, ঈদ উল আজহার সময়কালে কোরবানি অর্থাৎ ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু ও অন্যান্য পশু জবাইয়ের বিষয়ে একটি গবেষণার বরাতে নিয়মিত কিছু তথ্য ছড়াতে লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার টিম। অন্তত ২০১৯ সাল থেকেই প্রতিবছর মূলত ঈদ উল আজহার সময় উক্ত তথ্যগুলো ফেসবুক পোস্ট আকারে ছড়ানো হয়ে থাকে। 

উক্ত ফেসবুক পোস্টগুলোতে মূলত দাবি করা হয়, জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শুলজ এবং ডক্টর হাজিমের করা এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাই করলে গরু ও অন্যান্য পশু ব্যথা অনুভব করে না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দাবিটির সূত্রপাত :

ফেসবুকের একাধিক মনিটরিং টুল ব্যবহার করে দাবিটির সূত্রপাত খোঁজার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। উক্ত দাবিটি ২০১৯ সালে সর্বপ্রথম ছড়াতে লক্ষ্য করা যায়৷ ২০১৯ সালের বেশ কিছু পোস্টে লেখাটির কার্টেসি হিসেবে Yeasin Alauddin নামটি ব্যবহার করতে দেখা যায়৷ যদিও Yeasin Alauddin এর পোস্টটি পাওয়া যায়নি, তবে ধরে নেওয়া যায় সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি ২০১৯ সালে Yeasin Alauddin নামের কোনো এক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতি বছর মূলত ঈদ উল আজহার সময় দাবিটি প্রচার হতে লক্ষ্য করা যায়।

Screenshot : Facebook

পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়, ইসলামিক পদ্ধতিতে গরু (ছাগলসহ হালাল প্রাণি) জবাইয়ের সময় গরু ব্যাথা অনুভব করে কি না এ নিয়ে একটা পরীক্ষা করেছিলেন জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শুলজ এবং ডক্টর হাজিম। গরু জবাইয়ের সময়ে EEG পরীক্ষা করে গরুর মস্তিষ্ক এবং ECG করে গরুর হার্ট দেখা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, জবাইয়ের প্রথম ৩ সেকেন্ডে EEG গ্রাফে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না, অর্থাৎ গরু কোনো ব্যাথা পায় না। পরের ৩ সেকেন্ডের EEG রেকর্ডে দেখা যায়, গরু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার মতো অচেতন হয়ে থাকে, শরীর হতে প্রচুর রক্ত বের হয়ে যাওয়ায় ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ হয় না বলে এই অচেতন অবস্থা হয়। এই ৬ সেকেন্ড পরে EEG গ্রাফে Zero level দেখাচ্ছিলো, তার মানে গরু কোনো ব্যাথা পাচ্ছিলো না।। গরুর যে খিচুনি আমরা দেখি সেটা Spinal cord এর একটি Reflex Reaction, এটি মোটেও ব্যাথার জন্য হয় না।

গবেষণাপত্রটির সন্ধানে রিউমর স্ক্যানার:

আলোচিত পোস্টগুলোতে প্রফেসর শ্যুলজ এবং ডক্টর হাজিমের যে গবেষণার কথা বলা হয়েছে, সেই গবেষণার সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম। মূল জার্মান ভাষার গবেষণাপত্রটি পাওয়া না গেলেও, গবেষণাপত্রটির ইংরেজি অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে। গবেষণাপত্রটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, ব্রিটেনের ইসলামিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রফেসর ডক্টর সাহিব মুস্তাকিম ব্লেহার। গবেষণাপত্রটির ইংরেজি শিরোনাম [Objectivization of pain and consciousness in the conventional (dart-gun anesthesia) as well as in ritual (kosher incision) slaughter of sheep and calf]. অর্থাৎ, গবেষণাটিতে ধর্মীয় রীতি বলতে ইহুদিদের কোশার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা হয়েছিল। তবে, ইহুদিদের কোশার ও মুসলিমদের কোরবানির মধ্যে পদ্ধতিগত মিল রয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রায় ৪৬ বছর পূর্বে ১৯৭৮ সালে জার্মান জার্নাল Deutsche Tieraerztliche Wochenschrift (German veterinary weekly) এর ফেব্রুয়ারী সংখ্যার ভলিউম ৮৫ এর ৬২ থেকে ৬৬ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। উক্ত ইংরেজি ভাষান্তরিত গবেষণাটিতে দেখা যায়, গবেষণাপত্রটির সাইটেশন সংখ্যা ৪ বা এখন পর্যন্ত ৪ বার সাইটেশন গ্রহণ করেছে। সাইটেশন গ্রহণ বলতে বুঝায়, কোনো একটি গবেষণাপত্রের কথা অন্য কোনো গবেষণায় ঠিক কতবার উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই গবেষণাপত্রটির ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৪ অর্থাৎ এখন পর্যন্ত ৪ টি আর্টিকেল বা গবেষণায় উক্ত গবেষণার কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে যা সংখ্যাগতভাবে বেশ কমই।

গবেষণাটিতে মূলত পশুর মৃত্যু ঘটাতে প্রচলিত ক্যাপটিভ বোল্ট স্টানিং পদ্ধতিতে পশুর মৃত্যু ঘটানো এবং ধর্মীয় রীতিতে পশুর মৃত্যু ঘটানোর সময় পশুর ব্যথা এবং চেতনার তুলনা করে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ক্যাপটিভ বোল্ট স্টানিং পদ্ধতি হচ্ছে ক্যাপটিভ বোল্ট পিস্তল দিয়ে কোনো পশুকে অত্যন্ত কাছে থেকে আঘাত করে মারার একটি পদ্ধতি। 

উল্লিখিত গবেষণাটি করতে মোট ২৩ টি ভেড়া এবং ১৫টি বাছুরের হৃৎপিণ্ডের কম্পাঙ্ক এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম পরিমাপ করা হয়। যার মধ্যে ধর্মীয় পদ্ধতিতে ১৭ টি ভেড়া এবং ১০টি বাছুর ব্যবহার করা হয়। বাকী ৬টি ভেড়া এবং ৫টি বাছুরকে মারার ক্ষেত্রে ক্যাপটিভ বোল্ট ব্যবহার করা হয়।

গবেষণার ফলাফল:

গবেষণাটিতে ধর্মীয় পদ্ধতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, পশু কাটার পর প্রাথমিক পর্যায়ে ও কাটার পূর্বে EEG এর মান একই ছিল, তেমন কোনো পার্থক্য বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, গবেষণাটি অনুযায়ী ধরে নেওয়া যায় পশু ব্যথা পায়নি। উল্লেখ্য, মস্তিষ্কের কার্যক্রম ও নানা অবস্থা পরিমাপের বা বুঝার ক্ষেত্রে EEG ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

Screenshot : Research Paper

অপরদিকে ক্যাপ্টিভ বোল্ট দিয়ে পশু মারার সময় পশুর মস্তিষ্কে ১-২ হার্জ মাত্রার কম্পাঙ্ক দেখতে পাওয়া যায়।

ধর্মীয় পদ্ধতিতে ১৭টি ভেড়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৩ সেকেন্ডের ভিতর EEG লাইন শূন্য হয় অর্থাৎ পশু ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ করে। এবং ধর্মীয় পদ্ধতিতে ৭টি বাছুরের ক্ষেত্রে EEG তে জিরো লাইন হয় সর্বোচ্চ ২৩ সেকেন্ডের ভেতর। অর্থাৎ, ধর্মীয় পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ২৩ সেকেন্ডের ভেতর বাছুর ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ করে। 

অপরদিকে ক্যাপ্টিভ বোল্টের পদ্ধতিতে ৪ টি বাছুরের ক্ষেত্রে ২৮ সেকেন্ড পর EEG জিরো লাইন স্পর্শ করে বা পশু ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ধর্মীয় পদ্ধতিতে পশু তুলনামূলক দ্রুত ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ করছে। 

এসব তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে গবেষণাটিতে বলা হয়, EEG রেকর্ডিং এবং রক্ষণাত্মক প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতি মোতাবেক, সঠিক পদ্ধতিতে ধর্মীয়ভাবে পশু জবাই করা হলে, তা ভেড়া এবং বাছুরের ক্ষেত্রে ব্যথাহীন।

Screenshot : Research Paper

তবে, গবেষণাপত্রটিতে এর পরবর্তী অংশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের নানা প্রজাতির পূর্ণবয়স্ক গরুর উপর ব্যথার বিষয়ে গবেষণা করার জন্য বলা হয়।

Screenshot : Research Paper

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টের সাথে গবেষণাপত্রটির অমিল বা অসংগতি :

১। অনুবাদকৃত রিসার্চ পেপার অনুযায়ী, ধর্মীয় পদ্ধতি এবং ক্যাপ্টিভ বোল্ট পদ্ধতিতে পশুর মৃত্যু ঘটানোর মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। অনুবাদে ধর্মীয় পদ্ধতি (ritual cut) হিসেবে উল্লেখ করা হলেও National Library of Medicine এ গবেষণাপত্রটির ইংরেজি ভাষান্তরিত শিরোনামে ধর্মীয় পদ্ধতি হিসেবে কোশার পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোশার পদ্ধতি বলতে ইহুদিদের ধর্মীয় পদ্ধতি বোঝানো হয়ে থাকে, মুসলিমদের নয়। তবে, কোশার পদ্ধতি ইহুদিদের হলেও এর সাথে ইসলামিক রীতিরও মিল রয়েছে।

২। গবেষণাটিতে ভেড়া এবং বাছুর ব্যবহার করা হয়েছে। গরু ব্যবহার করা হয়নি। গবেষকরা পূর্ণবয়স্ক গরুর ক্ষেত্রে আবারও রিসার্চ করতে বলেছেন। তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গবেষণাটিতে গরু ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।

৩। আলোচিত পোস্টগুলোতে ৩ সেকেন্ড, ৬ সেকেন্ডের সময়ে EEG এর গ্রাফ এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার মতো কথাগুলো বলা হলেও গবেষণাপত্রে এরকম কিছু পাওয়া যায়নি। তবে, গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে ভেড়াগুলো ৪ থেকে ৬ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হারানোর জোড়ালো সম্ভাবনা আছে, অপরদিকে বাছুরের ক্ষেত্রে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে। (There is a high probability that the loss of reaction took place within 4 – 6 seconds for sheep and within 10 seconds for calves.)

শেষের পয়েন্টের বিষয়ে যদিও গবেষণাপত্রটিতে কিছু বলা হয়নি, তবে গবেষণাপত্রটির ইংরেজি অনুবাদক ডক্টর ব্লেহারের ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি নিজের ওয়েবসাইটে ৩ সেকেন্ড, ৬ সেকেন্ড এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদি কথা উল্লেখ করেন। সেখানে রেফারেন্স হিসেবে নিজের অনুবাদ করা গবেষণাপত্রটির কথা উল্লেখ করলেও তার নিজের অনুবাদ করা গবেষণাপত্রে তার দাবির স্বপক্ষে এরকম কিছু পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, উক্ত ৩ এবং ৬ সেকেন্ডের তথ্যগুলো গবেষণাপত্রটির অনুবাদক ব্লেহারের ওয়েবসাইটের আর্কাইভ সংস্করণে পাওয়া গেলেও বর্তমান সংস্করণে পাওয়া যায়না৷ অর্থাৎ, এই ৩ সেকেন্ড এবং ৬ সেকেন্ডের উল্লেখকৃত শব্দ তিনি নিজেই পরবর্তীতে সরিয়ে নিয়েছেন।

Screenshot : Bleher’s website ; Mustaqim Islamic Art & Literature

অতঃপর, জবাই করার সময় গরু ও অন্যান্য পশু ব্যথা পায় কি পায় না তা নিয়ে সাম্প্রতিক বা এই দশকের গবেষণা বা নিবন্ধের অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে IFCN স্বীকৃত স্পেন ভিত্তিক কাতালান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান verificat এর একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার। উক্ত ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদনে একাধিক গবেষণা ও বইয়ের সূত্রের উপর ভিত্তি করে তারা সিদ্ধান্ত জানায়, পশু ব্যথা অনুভব করে। এক্ষেত্রে হত্যা করার আগে পশুকে অবচেতন করে নেওয়া যেতে পারে। অবচেতন করার জন্য প্রথমে পশুটির নড়াচড়া করার শক্তি থামাতে হবে। যদিও এই প্রক্রিয়াটিও কষ্টদায়ক। তবে, অবচেতন ছাড়া জীবনাবসান ঘটানোর চেয়ে এটি তুলনামূলক কম সময় নেয় বা কম কষ্ট দেয় পশুকে। উক্ত কথাগুলো অ্যান্তোনিও ভেলার্দে নামের একজন গবেষকের বরাতে প্রকাশ করে ভেরিফিক্যাট। 

তাছাড়া, পশু ব্যথা পায় শীর্ষক উক্ত দাবির স্বপক্ষে তাদের যুক্ত করা সূত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে, নিউজিল্যান্ড ভেটেরিনারি জার্নালে “Electroencephalographic responses of halothane-anaesthetised calves to slaughter by ventral-neck incision without prior stunning” শিরোনামে প্রকাশ হওয়া একটি গবেষণাপত্র, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির Animal Science এর প্রফেসর টেম্পল গ্র্যান্ডিন এর “Improving Animal Welfare | 3rd Edition | A Practical Approach” শিরোনামের সম্পাদিত বই, বৈজ্ঞানিক ও মেডিক্যাল ডাটাবেজ সায়েন্স ডিরেক্টে “Recent concerns about stunning and slaughter” শিরোনামে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র এবং আফ্রিকান জার্নাল এবং বায়োটেকনোলজিতে “Animal welfare in multipurpose cattle production Systems and its implications on beef quality” শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্র। 

অর্থাৎ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যে গবেষণাপত্রের বরাতে ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাই করলে গরু ও অন্যান্য পশু ব্যথা অনুভব করে না শীর্ষক দাবি প্রচার করা হচ্ছে তাতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে এবং প্রচারিত দাবির সাথে গবেষণাপত্রটিরও কিছু অমিল বা অসংগতি রয়েছে। একইসাথে, বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ গবেষণার মতে অবচেতন না করে কোনো পশুর জীবনাবসান ঘটানো হলে পশুটি ব্যথা অনুভব করে থাকে। তবে, এই অবচেতন করার প্রক্রিয়াটিতেও ব্যথা অনুভব হয়। সুতরাং, প্রচারিত পোস্ট, দাবিকৃত গবেষণাপত্র কিংবা বর্তমান গবেষণা, সব কিছুর মধ্যেই পার্থক্য বা অমিল লক্ষ্য করা যায়।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img