ঘটনার সম্ভাব্য শুরুটা গতকাল অর্থাৎ ০৮ অক্টোবর দুপুরে। দুপুর তিনটার কিছু পরে ফেসবুকের কিছু পোস্টের ভাষ্য এমন ছিল, “হটাৎ ঢাকা যমুনা তে সেনাবাহিনী টাং সব নিয়ে বসে আছে ব্যাপার কি।” সন্ধ্যার পরও একই দাবি প্রচার করে পোস্ট হচ্ছিল ফেসবুকে।

০৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনের সামনে সেনাবাহিনীর অবস্থান দেখা যায়। প্রধান উপদেষ্টা বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করছেন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনাকে। এই বাসভবন ঘিরে পিজিআর, এসপিবিএন, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। থাকছে সেনাবাহিনীর এপিসিও (সাঁজোয়া যান)। তাই গতকাল শুরুতে যে দাবিটি প্রচার হচ্ছিল তা নিতান্তই কৌতূহল সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। রিউমর স্ক্যানার বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায়, গত রাত অন্তত নয়টার পর থেকে ফেসবুকে প্রচার হতে থাকে যে, “রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড.ইউনূসকে ঘিরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রুদ্ধশ্বাস বৈঠক চলছে। বিক্ষুদ্ধ আর্মি অফিসাররা ইউনূসকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।” দাবি করা হয়, “গত দুই মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি ইউনূস। ইউনূসের সময় ঘনিয়ে এসছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। তাকে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে আজ। এরমধ্যে নির্বাচন দিয়ে পদত্যাগ করতে হবে ইউনূসকে।” পরবর্তী কয়েকঘন্টার মধ্যে এই দাবি ব্যাপকভাবে প্রচার হতে থাকে ফেসবুকে। সমজাতীয় দাবিতে কাজী মামুন এবং মুফাসসিল ইসলাম নামে দুইটি অ্যাকাউন্টের পোস্টের বরাতে বিষয়টি ভাইরালে রূপ নেয়। ফেসবুক থেকে বিষয়টি ছড়ায় ইউটিউব (১, ২) এবং টিকটকেও।

গতকাল রাত ১২ টার কিছু সময় পর যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানা পোলেন তার এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, “ইউনূসকে ওয়াকার উজ জামান, সাতদিন সময় বেঁধে দিয়েছে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পক্ষান্তরে ইউনূস, ওয়াকার উজ জামানকে ২৪ ঘন্টার টাইম বেধে দিয়েছে পদত্যাগ করতে! সার্ভিস আলম সেনাপ্রধানের সঙ্গে বেয়াদবি করায় তাকে ধমকে বসিয়ে দিয়েছে আর্মির অফিসারদের কেউ একজন। বাকবিতন্ডা চলছে! এটাই যমুনার সর্বশেষ আপডেট।” (বানান অপরিবর্তিত)

এখানে সার্ভিস আলম বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমকে বোঝানো হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রিউমর স্ক্যানার এ বিষয়ে জানতে সারজিসের সাথে কথা বলেছে। তিনি বলছিলেন, তিনি গতকাল বিকেলের পর থেকে তার পরিবারের সাথে রয়েছেন। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি অপূর্ব জাহাঙ্গীর এবং সেনাবাহিনীর একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকতার সাথেও কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার৷ তারা বিষয়টিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন৷
রাত একটার কিছু পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাজমুল হাসান যমুনার সামনে থেকে একটি লাইভ ভিডিও প্রকাশ করেন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। তার ভিডিওতে যমুনার সামনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান হয়। নাজমুল আরেকটি ভিডিওতে জানান, আলোচিত দাবিটি সম্পূর্ণ গুজব। তার ভিডিওতে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করা যায় যা অন্যান্য দিনেও বিদ্যমান থাকে। ভাইরাল দাবিটির বিষয়ে অপতথ্যের প্রবাহ এখানেই থেমে যেতে পারতো। তবে রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে উল্টো চিত্র উঠে আসতে শুরু করে। আমাদের সামনে একটি ভিডিও আসে, যার ক্যাপশনে দাবি করা হয়, যমুনায় সেনাবাহিনীর সাথে উপদেষ্টাদের বাকবিতন্ডার ভিডিও এটি। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, এটি যমুনার সামনের কোনো ভিডিও নয়। গত ০৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইতালির দূতাবাসের সামনে ভিসা প্রত্যাশীদের জমায়েতের ভিডিও এটি।

কাছাকাছি সময়ে যমুনার সামনের ভিডিও দাবিতে আরেকটি ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কিছু সেনা সদৃশ সদস্য যমুনায় প্রবেশ করছেন। জিওলোকেশন যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, ভিডিওটি যমুনার সামনে থেকেই ধারণ করে৷ তবে রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে ভিডিওতে কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির সাথে কথা বলে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাদের ধারণা, ডিউটির সময় বদল হওয়ায় একদল সেনা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের যমুনায় প্রবেশের ফুটেজ হতে পারে এটি। তাছাড়া, সমন্বয়ক নাজমুলের লাইভ ভিডিও থেকেও স্পষ্ট যে, যমুনার সামনে কোনো অস্বাভাবিক বা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবতারণা হয়নি।

কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্টে যমুনার সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িবহরের অবস্থানের দৃশ্য দাবি করে একটি ছবি প্রচার করা হচ্ছে। তবে যাচাই করে দেখা যায়, রাজবাড়ীতে গতকাল সকালে দুর্গাপূজা মন্দিরের ৫টি প্রতীমার মুখের অংশ আংশিক ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে অবস্থানের দৃশ্য এটি।

এদিকে কিছু ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়, সমন্বয়ক থেকে উপদেষ্টা পদে যাওয়া এক ব্যক্তিকে যমুনায় বৈঠকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন এক সেনা অফিসার। কথিত এই দাবির প্রেক্ষিতে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ভিডিও ফুটেজ প্রচার করা হয়, যাতে হাসনাতকে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হতে আহ্বান জানাতে দেখা যায়৷ তবে ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়। গত ২৫ আগস্ট হাসনাত তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভ ভিডিওটি প্রকাশ করেন যাতে তিনি জানান, “সবাই রাজুতে আসেন। স্বৈরাচারীশক্তি আনসার হয়ে ফিরে আসতে চাচ্ছে। দাবি মানার পরও আমাদের সবাইকে সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছে।”

সমন্বয়ক সারজিস আলমও রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দাবিতে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম ব্যবহার করে ভুয়া পোস্টের স্ক্রিনশট বানিয়েও প্রচার করা হয়েছে। আদতে সারজিস এমন কোনো পোস্টই করেননি।

রিউমর স্ক্যানার ভাইরাল এসব দাবিগুলো নিয়ে যাচাই করতে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি প্রেস রিলিজের ছবি খুঁজে পায়। ফেসবুকের একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে কথিত এই প্রেস রিলিজে। সাধারণ জনগণকে আহ্বান জানানো হয় রাস্তায় নেমে আসার৷ দাবি করা হয়, আরেকটি লড়াই করার সময় হয়েছে।

সেনাবাহিনীর প্রেস রিলিজ সাধারণত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মাধ্যমে প্রচার করা হয়৷ রিউমর স্ক্যানার এ বিষয়ে জানতে আইএসপিআরে যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকে রিউমর স্ক্যানারকে জানানো হয়, এই প্রেস রিলিজটি তাদের প্রকাশিত নয়। আইএসপিআর বলছে, তারা প্রেস রিলিজ প্রকাশ করলে তাতে সেনা কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর থাকে এবং তা অফিশিয়াল প্যাডে প্রকাশিত হয়৷ একইসাথে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় প্রেস রিলিজ। এর কোনোটিই কথিত এই প্রেস রিলিজের ক্ষেত্রে ঘটেনি৷
অর্থাৎ, গতকাল (০৮ অক্টোবর) অন্তত দুপুর থেকে রাষ্ট্র্রীয় অতিথি ভবন যমুনা যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সেখানে সেনাবাহিনীর কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার ইঙ্গিতপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটে ফেসবুকে৷ শুরুতে যমুনায় সেনাবাহিনীর ট্যাংকের অবস্থানের বিষয় তুলে ধরে কৌতূহল সৃষ্টি করা হয়। যদিও গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে ট্যাংকের অবস্থান দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক বিষয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন (বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন) যমুনাসহ রাষ্ট্রীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে সেনাবাহিনী ট্যাংকের মাধ্যমে টহল দিচ্ছে। পরবর্তীতে রাতে ভাইরাল হতে থাকে সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে ড. ইউনূসের দ্বন্দ্বের দাবি। যদিও এমন কোনো প্রমাণ রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে মেলেনি৷ পরবর্তী সময়ে এই দাবিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সেনাবাহিনীর নিয়মিত কার্যক্রমের ভুয়া ভিডিও, সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিও, সমন্বয়ক সারজিস আলমের নামে ভুয়া পোস্ট স্ক্রিনশট, ভিন্ন ঘটনার ছবি- ভিডিও, সেনাবাহিনীর নামে ভুয়া প্রেস রিলিজসহ একাধিক উপায় অবলম্বন করে ক্রমাগত প্রচার করা হয়েছে বিষয়টি৷ আর্মি প্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টার কথিত এই দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে ঘিরে গত রাতে মূল দাবিসহ অন্তত আটটি গুজব প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।