পুরুষ তার অন্ডকোষে আঘাত পেলে কী ৯০০০ ডেল ব্যথা অনুভব করে?

ব্যথা মানবদেহের এক অস্বস্তিকর অনুভূতির নাম। ধরণভেদে ব্যথায় যেমন আছে ভিন্নতা তেমনি ব্যক্তিভেদে ব্যথার তীব্রতা অনুভবেও দেখা যায় পার্থক্য। ব্যথা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল ও বিভ্রান্তিকর  তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। 

ব্যথা বিষয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর নমুনা

১.  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুনিয়া” নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ২০২২ সালের ১৫ জুন “আপনি জানেন কি? (আর্কাইভ)” শিরোনামে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, পুরুষ মানুষ তার “অন্ডকোষে” আঘাত পেলে প্রায় ৯০০০ ডেল পর্যন্ত ব্যাথা অনুভব করতে পারে ……। 

২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “Staysafe” নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ২০২১ সালের ২৭ মে “World Menstrual Hygiene Day” উপলক্ষ্যে ছবিসহ একটি তথ্য প্রকাশ করা হয় (আর্কাইভ)”। পোস্টে উল্লেখ করা হয়, “সাধারণ মানুষ তার দেহে সর্বোচ্চ ৪৫ ডেল পর্যন্ত ব্যাথা সহ্য করতে পারে। কিন্তু একজন নারী বাচ্চা জন্ম দেবার সময় ৫৭ ডেল এরও উপরে ব্যাথা সহ্য করে।……। 

অন্ডকোষে ব্যথা পেলে ৯০০০ ডেল ব্যথা অনুভূত হয় এমন দাবিতে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে , এখানেএখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে। 

ডেল কী?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আসা সংশ্লিষ্ট পোস্টগুলোতে অন্ডকোষে ব্যথা পরিমাপের একক হিসেবে ‘ডেল’ এককের ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডেল নামে কোনো ব্যথা পরিমাপক একক নেই। তবে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ডল নামে একটি এককের ব্যাপারে জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কর্ণেল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক ব্যথার তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য “ডল স্কেল/ Dol Scale” নামের একটি একক তৈরির প্রস্তাব করেন যা তারা ১৯৪৮ সালে তাদের “STUDIES ON PAIN: AN INVESTIGATION OF SOME QUANTITATIVE ASPECTS OF THE DOL SCALE OF PAIN INTENSITY” শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। ব্যথার তীব্রতা পরিমাপে ‘ডেল নামে কোনো একক নেই‘ এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির একটি ফ্যাক্ট চেক বিষয়ক প্রতিবেদনেও। ভারতের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান Factly এর একটি প্রতিবেদনেও একই তথ্য এসেছে। World Federation of Societies of Anesthesiologists এর আইনি ও গণসংযোগ কর্মকর্তা Annabel Higgins ফেডারেশনটির চিকিৎসক Dr Charles Rouger Goucke এর বরাত দিয়ে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান Africa Check কে জানিয়েছেন, ডেল একক একটি শহুরে মিথ, যা ইন্টারনেটে জীবিত রাখা হয়েছে।

তাই বলা যায়, ব্যথা পরিমাপ করার জন্য “ডেল” নামে কোনো একক নেই।

ডল এককে অন্ডকোষের ব্যথা পরিমাপ করা সম্ভব?

ডেল একক না থাকলেও ডল নামে একটি এককের অস্তিত্ব রয়েছে। ডল একক নিয়ে ১৯৪৮ সালের গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত ডল স্কেলে সর্বাধিক ব্যথার তীব্রতার পরিমাপ হচ্ছে ১০.৫।  

অর্থাৎ ১০.৫ এর বেশি ডল ব্যথা পরিমাপ করা সম্ভব নয় এই স্কেলে। তাই আলোচিত পোস্ট গুলোতে অন্ডকোষে ব্যথার তীব্রতা পরিমাপে ৯০০০ বা ৯০০ ডেলের যে কথা বলা হচ্ছে তা ডল স্কেলে হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া ডেল স্কেল নামের ব্যথা পরিমাপক এককের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আর ডল স্কেল নামে যে এককের কথা বলেছেন গবেষকরা সেই এককটি কখনোই তেমন ব্যবহার হতে দেখা যায় নি। 

ব্যথা পরিমাপে ডেল ছাড়া কি অন্য এককও প্রচলিত? 

ব্যথার তীব্রতা পরিমাপ বিষয়ে ২০১৮ সালে Harvard Health Publishing এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চিকিৎসক ও রোগীরা ব্যথার তীব্রতা নির্ণয় করতে ১০ ক্রমধারার একটি ব্যথার স্কেল ব্যবহার করছেন। এই স্কেলটি প্রাথমিকভাবে তৈরি করা হয়েছিল, নার্স এবং ডাক্তারদের জন্য যাতে তারা আরও ভালভাবে ব্যথার ব্যাপারে অবগত হন এবং ব্যথার তীব্রতা সম্পর্কে জেনে সে অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। 

Oxford Academic ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও Numeric rating scales (NRS) নামক প্রায় একই রকম আরেকটি স্কেলের বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে ০ থেকে শুরু করে ১০ পর্যন্ত রেটিং দেওয়া এই স্কেলে ০ দাগ বলতে ‘কোনো ব্যথা নেই’ বোঝানো হয়৷ অপরদিকে ১০ দাগ বলতে ‘তীব্র ব্যথা’ বোঝানো হয়েছে।  

অন্ডকোষে

তবে এগুলোই যে ব্যথা পরিমাপকের একমাত্র মানদন্ড এমন নয়। অনুসন্ধানে healthline ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে  Visual analog scale (VAS), Initial pain assessment tool সহ আরো কিছু ব্যথা পরিমাপক পদ্ধতির ব্যাপারে জানা যায়। চিকিৎসকরা বিভিন্ন সময়ে এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে আসছেন৷ তবে ব্যথা পরিমাপে এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যালী গ্রহণযোগ্য কোনো পরিমাপক নেই । 

অন্ডকোষে ব্যথা পরিমাপের বিষয়টি ভুয়া?

Medical News Today ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,  মানব শরীরে থাকা বিশেষায়িত স্নায়ু কোষ ‘Nociceptors‘ মূলত ব্যাথা সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিছু কিছু নোসিসেপ্টর খুব দ্রুত অনুভূতির সংকেত স্পাইনাল কর্ডে ও মস্তিষ্কে  পাঠায় এবং তীব্র ও আকষ্মিক ব্যাথার অনুভুতি জাগায়। অন্ডকোষে প্রচুর পরিমাণে এই স্নায়ু কোষটি থাকে যা একে সংবেদনশীল করে তোলে। এতে করে ব্যথার তীব্রতায় প্রভাব পড়ে।

আরো পড়ুনঃ সন্তান প্রসবের সময় একজন মায়ের ৫৭ ডেল ব্যথা অনুভব করার দাবিটি মিথ্যা

AsapSCIENCE নামে বিজ্ঞানভিত্তিক একটি ইউটিউব চ্যানেল ২০১৩ সালে এই প্রসঙ্গে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, অন্ডকোষে ব্যথার ধরণ ও তীব্রতা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। শুধু ব্যক্তিভেদেই ভিন্নতা নয়, এই ব্যথা নির্ভর করে ব্যক্তির অবস্থা,  সতর্ক প্রবণতা কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতার উপরও। এই ভিডিওতেও ডেল এককটি অস্তিত্বহীন বলে উল্লেখ করা হয়।

শরীরের অন্যান্য অংশের ব্যথা পরিমাপকে ডাক্তাররা যে স্কেল বা পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন অন্ডকোষের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি ব্যবহার সম্ভব। তবে ৯০০০ ডল ব্যথা অনুভবের যে তথ্য ছড়িয়েছে তা ডল স্কেলে সম্ভব নয়। কারণ ডল স্কেল সর্বোচ্চ ১০.৫ পর্যন্ত ব্যথা পরিমাপ করতে সক্ষম।  

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন? 

আধুনিক নানা পদ্ধতি ব্যবহার করেও ব্যথা পরিমাপ করা কঠিন। ২০১৮ সালে National Library of Medicine এ প্রকাশিত ব্যথা প্রসঙ্গে The Multimodal Assessment Model of Pain শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “ব্যথা একটি বিষয়গত অভিজ্ঞতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যার মানে এটি সরাসরি যারা এটি অনুভব করছেন না তাদের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা যাবে না।”

World Federation of Societies of Anesthesiologists এর আইনি ও গণসংযোগ কর্মকর্তা Annabel Higgins ফেডারেশনটির চিকিৎসক Dr Charles Rouger Goucke এর বরাত দিয়ে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Africa Check কে জানিয়েছেন, “বিভিন্ন রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের এবং ব্যথার মাত্রা তুলনা করা সহজ নয়। যা আমাকে কষ্ট দেয় তা হয়তো আপনাকে আঘাত নাও করতে পারে কিংবা ঘটতে পারে তার উল্টোটা!! স্কেল ০ অর্থাৎ ‘কোন ব্যথা নেই’ থেকে স্কেলে ১০ দাগ অর্থাৎ ‘তীব্র ব্যথা’ হিসেবে গ্রেড করা যেতে পারে। প্রসব বেদনা, পিত্তথলির পাথর এবং কিডনিতে পাথর সবই মারাত্মক ব্যথার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রকৃত তীব্রতা খুবই ব্যক্তিগত।” 

ভারতের নিউ দিল্লির প্রাইমাস সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চিকিৎসক Dr. Sorabh Garg Vishvas news কে বলছেন, “ব্যথা পরিমাপের কোন বস্তুনিষ্ঠ উপায় নেই। ব্যথা একটি বিষয়গত অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন রোগীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের এবং ব্যথার মাত্রা তুলনা করা সহজ নয়। কেউ বাস্তবিকভাবে ব্যথা পরিমাপ করতে পারে না। প্রকৃত তীব্রতা খুবই ব্যক্তিগত। 

মূলত, কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্যসূত্র ছাড়াই “পুরুষ তার অন্ডকোষে আঘাত পেলে ৯০০০ ডেল ব্যথা অনুভব করে” শীর্ষক দাবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে যেখানে ডেল নামক ব্যথা পরিমাপের কোনো একক ই নেই। অন্যদিকে গবেষণা প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মত জানাচ্ছে, অন্ডকোষ বা দেহের কোনো অংশেরই ব্যথা পরিমাপের কোনো বস্তুনিষ্ঠ উপায় নেই। রোগী ভেদে এই ব্যথা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার হতে পারে।

সুতরাং, পুরুষ তার অন্ডকোষে আঘাত পেলে ৯০০০ ডেল ব্যথা অনুভব করার তথ্যটির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং ব্যথা পরিমাপে ডেল নামে কোনো এককও নেই।

আরও পড়ুন

spot_img