আইকিউ র‍্যাংকিং নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

বুদ্ধিমত্তা শব্দটার সাথে আমাদের সখ্যতা ছোটবেলা থেকেই। কারো বুদ্ধি কম বলে তাকে যেমন নানা কথা শুনতে দেখেছি, তেমনি কারও-বা বুদ্ধি বেশি বলে তাকে প্রশংসায় ভাসতে দেখাও নিয়মিত ঘটনা ছিল। এই বুদ্ধি কম বা বেশির প্রশ্নে সামনে আসে আইকিউ’র বিষয়টি। এক শতাব্দীর অধিক সময় ধরেই মানুষের বুদ্ধি মাপার ক্ষেত্রে ব্যাক্তির আইকিউ হিসেব করা হচ্ছে। কিন্তু এই আইকিউ হিসাবের পদ্ধতি এবং র‍্যাংকিং নিয়ে বহু বছর ধরেই বিতর্ক চলে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমনই এক র‍্যাংকিং নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

আইকিউ’র প্রাথমিক পাঠ

আইকিউ’র (IQ) পূর্ণরূপ Intelligence Quotient. বাংলায় শব্দটি বুদ্ধিমত্তা বা বুদ্ধান্ক হিসেবে পরিচিত। আইকিউ স্কোর হলো এমন একটি সংখ্যা যা মৌখিক বোধগম্যতা, অনুধাবনমূলক যুক্তি, স্মৃতি  এবং প্রক্রিয়াকরণের গতির ক্ষেত্রগুলোর পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একজন ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করার চেষ্টা করে।

সারাবিশ্বে আইকিউ নির্ধারণে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯০৪ সালে ফ্রান্সের স্কুলগুলোতে কোন কোন শিক্ষার্থীদের বিশেষ যত্ন দরকার, এটি ঠিক করার জন্য ফ্রান্স সরকার মনোবিদ আলফ্রেড বিনেত এবং থিওডর সাইমনকে একটি পদ্ধতি ঠিক করতে বলে। বিনেত এবং সাইমন মস্তিষ্কের বিকাশের কিছু প্রকাশমাধ্যম যেমন মৌখিক যুক্তি, কাজের স্মৃতিশক্তি এবং চাক্ষুষ-স্থানিক দক্ষতা ইত্যাদি যাচাই করার জন্য বেশ কিছু পরীক্ষামালা উদ্ভাবন করেন এবং প্রাপ্ত ফলাফলকে স্কোরিং করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এটিই ছিল প্রথম কোনো স্বীকৃত আইকিউ টেস্ট। তবে এই টেস্টের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। একই ধরনের শিশুদের ক্ষেত্রে এই টেস্ট তুলনা করা গেলেও সময়ের সাথে সাথে বয়স ও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে একেকজনের আইকিউ পরীক্ষায় একেক ফলাফল আসে। একটি অসম্পূর্ণ পরিমাপ পদ্ধতি হিসেবেও এটিকে আখ্যা দিয়েছেন কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী।

Screenshot source : very well mind

পরবর্তীতে স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ এল. এম. টারম্যান ১৯১৬ সালে বিনেত-সিমন টেস্টকে কিছুটা পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করেন, যা স্ট্যানফোর্ড-বিনেত ইন্টেলিজেন্স স্কেল নামে পরিচিতি পায়। এই টেস্টে আইকিউ শব্দটি ব্যবহার হতে দেখা যায়। আইকিউ স্কোর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যেমন বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার রয়েছে তেমনি কোনো আইকিউ স্কোর ঠিক কী নির্দেশ করে সেই স্কোর সীমাতেও ভিন্নতা এসেছে সময়ে সময়ে। ২০০৯ সালে মার্কিন গবেষক ডেভিড ই. হার্টমেন প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম Insider বলেছে, যাদের আইকিউ স্কোর ৬৯ বা তার নিচে হবে তাদের বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত নিম্ন। একইভাবে ৭০-৭৯ বুদ্ধির সীমারেখায়, ৮০-৮৯ নিম্ন গড়, ৯০-১০৯ গড়, ১১০-১১৯ গড়ের চেয়ে বেশি, ১২০-১২৯ উচ্চতর এবং ১৩০ বা তার বেশি আইকিউ স্কোরধারীকে অধিক উচ্চতর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী বলে বিবেচনা করা হবে।

Screenshot source : Insider

সাম্প্রতিক যে র‍্যাংকিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে

চলতি বছর (২০২২) সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে মার্কিন প্রতিষ্ঠান World Population Review দেশভিত্তিক গড় আইকিউ তালিকা প্রকাশ করে। তালিকায় দেখা যায়, সর্বোচ্চ আইকিউ (১০৬.৪৮) নিয়ে প্রথম অবস্থানে জাপান এবং পরের চার অবস্থানে যথাক্রমে তাইওয়ান (১০৬.৪৭), সিঙ্গাপুর (১০৫.৮৯), হংকং (১০৫.৩৭) এবং চীন (১০৪.১) রয়েছে। র‍্যাংকিংয়ে প্রথম দশটি দেশের প্রথম ছয়টিই এশিয়ার৷

Screenshot source: World Population Review

তালিকায় ৭৪.৩৩ আইকিউ নিয়ে ১৯৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০ তম।

Screenshot source: World Population Review

এ বিষয়ে দেশীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন – সময় টিভি (আর্কাইভ),  বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা (আর্কাইভ), বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজি (আর্কাইভ), বাংলাদেশ প্রতিদিন (আর্কাইভ), ঢাকা মেইল (আর্কাইভ), বিজনেস পোস্ট (আর্কাইভ), যমুনা টিভি (আর্কাইভ), ডেইলি ক্যাম্পাস (আর্কাইভ)।

একই বিষয়ে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে

একই বিষয়ে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন এখানেএখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানেএখানে

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের র‍্যাংকিংয়ে বিভ্রান্তি?

মার্কিন ফুল স্টেক ফ্রিল্যান্স ডেভেলপার শ্যান ফালমার (Shane Fulmer) ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর চালু করেন World Population Review নামের ওয়েবসাইটটি। নিজস্ব কোনো উৎস না থাকায় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিভিন্ন গবেষণা ও সমজাতীয় নানান সূত্রের বরাতে ওয়েবসাইটটিতে বিভিন্ন র‍্যাংকিং প্রকাশ হয়ে আসছে। সম্প্রতি ওয়েবসাইটটিতে প্রকাশিত আইকিউ র‍্যাংকিংয়ের (আর্কাইভ) ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আইকিউ র‍্যাংকিংটি তৈরিতে ওয়েবসাইটটি চারটি ভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য নিয়েছে বলে দাবি করেছে।

Screenshot source: World Population Review

সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, সবগুলো সূত্রের তথ্যই ২০১৯ সালের পূর্বের (World Data.info ১৯৯০-২০১০, brainstats ২০০৬, Ulster ২০১৯ এবং Intelligence ২০১২)। অর্থাৎ, ওয়েবসাইটটির সাম্প্রতিক আইকিউ র‍্যাংকিং তিন বছর আগের তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা।

র‍্যাংকিংয়ে প্রধান সূত্র হিসেবে মার্কিন মনোবিদ রিচার্ড লিন (Richard Lynn) ও আরেক লেখক ডেভিড বেকারের (David Becker) লেখা বই ‘The Intelligence of the Nation‘ এর উল্লেখ রয়েছে। বইটি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের আইকিউ ৭৪.২৪।

Screenshot source: The Intelligence of the Nation (page 55)

কিন্তু World Population Review ওয়েবসাইটের আইকিউ র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের আইকিউ লেখা রয়েছে ৭৪.৩৩।

Screenshot source: World Population Review

অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৫১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন (জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২)। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন। কিন্তু World Population Review ওয়েবসাইটের আইকিউ র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১১ লক্ষ ৮৬ হাজার ৩৭২ জন বলা হয়েছে। অর্থাৎ জনসংখ্যার বর্তমান সরকারি সংখ্যার তুলনায় প্রায় ১ কোটি বেশি সংখ্যা দেখানো হয়েছে World Population Review ওয়েবসাইটের আইকিউ র‍্যাংকিংয়ে।

রিচার্ড লিনকে বিতর্কিত গবেষক বলা হচ্ছে কেন?

World Population Review ওয়েবসাইটের আইকিউ র‍্যাংকিং প্রকাশের পাতায় সূত্র হিসেবে উল্লিখিত গবেষক রিচার্ড লিনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ” লিনের গবেষণা ব্যাপক হলেও যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দেয়। কিছু গবেষক লিনের গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কারণ তিনি তার পদ্ধতিতে যে হার্ড ডাটা নিয়ে কাজ করেছেন সেটি গবেষণায় উল্লেখ ছিল না। অন্যরা দাবি করেন যে লিন একজন অপ্রতিরোধ্য ইউজেনিসিস্ট, বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের সমর্থনকারী। এর ফলে তিনি উভয় সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার জন্য তার ডাটার ভুল ব্যাখ্যা করেন।”

Screenshot source: World Population Review

ইউজেনিক্স নামক একটি তত্ত্বের সমর্থকদের ইউজেনিসিস্ট বলা হয়। এটি এমন একটি তত্ত্ব এবং অনুশীলন, যা নির্দিষ্ট আকাঙ্খিত বংশগত বৈশিষ্ট্যের সাথে বেছে বেছে শারীরিক মিলনের মাধ্যমে মানব প্রজাতির উন্নতির অনুশীলন বা সমর্থন করে। ইউজেনিক্সের প্রাথমিক সমর্থকরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে মানসিক অসুস্থতা, অপরাধপ্রবণতা এবং এমনকি দারিদ্র্যও পেয়েছে এবং এই শর্তগুলো জিন পুল থেকে বের করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে মানবসমাজ থেকে তথাকথিত নানা রোগ, প্রতিবন্ধকতা, মানসিক সমস্যা, খারাপ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দূর করা যাবে।

আইকিউ বিষয়ে রিচার্ড লিন বহু বছর ধরেই গবেষণা করছেন। কিন্তু তার গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। London School of Hygiene & Tropical Medicine এর বিবর্তনীয় জনসংখ্যাবিদ এবং নৃতত্ত্ববিদ ডাঃ রেবেকা সিয়ার (Rebecca Sear) লিনের ২০০২ ও ২০১৯ সালের আইকিউ বিষয়ক দুইটি গবেষণার সূত্র ধরে চলতি বছর (২০২২) একটি রিভিউ প্রকাশ করেন। রিভিউ পেপারে রেবেকা লিখেছেন, “২০০২ সালে লিন এবং ভ্যানহানেন একটি ডাটাসেট তৈরি করেছিলেন যা দাবি করেছিল এটা গড় ‘জাতীয় আইকিউ’ প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী  ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও, এই ডাটাসেট এবং পরবর্তী আপডেট হওয়া সংস্করণগুলো বিভিন্ন প্রকাশনায় ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আমি যদি সর্বশেষ সংস্করণ মূল্যায়ন করি যেটি লিন এবং বেকার দ্বারা ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়, সেটি দেখায় যে এই ডাটাসেটটি উদ্দেশ্যের সাথে মানানসই নয়। প্রাথমিক ‘জাতীয় আইকিউ’ অনুমান করার জন্য ডাটার উত্সগুলি অপর্যাপ্ত ছিল।”

রেবেকা জানান, “গবেষনাটির অধিকাংশ ডাটাই এমন কিছু নমুনা থেকে নেওয়া হয়েছে যা জাতীয় জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে না। বিভিন্ন জ্ঞানীয় পরীক্ষার পরিসর ব্যবহার করে ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং এত বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যা থেকে এই ডাটাগুলো নেওয়া হয়েছিল যে জ্ঞানীয় দক্ষতার তুলনা করাটা অসম্ভব।”

লিনের গবেষণায় ব্যবহ্রত ডাটাসেটকে রেবেকা শুধু ভুলই বলেন নি, একইসাথে পদ্ধতিগতভাবেই গবেষণাটি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল বলে তিনি অভিহিত করেন।

রেবেকা তার রিভিউ পেপারে লিখেছেন, “এ জাতীয় ডাটাসেট তুলনাযোগ্য, সঠিক এবং পক্ষপাতহীন জ্ঞানীয় দক্ষতা পরিমাপে সাহায্য করে না। এটি বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক পরিবর্তন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়ার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়।”

Screenshot source: PsyArXiv

রিচার্ড লিনের সর্বশেষ গবেষণাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের গড় আইকিউ নির্ধারণে লিন একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে ডাটা নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল বাংলাদেশী গবেষক হামাদানির ২০১১ সালের আর্সেনিক বিষয়ক একটি গবেষণা। এটি থেকে দুইটি নমুনা নিয়েছেন লিন। একটি নমুনায় শিশুদের এবং অন্যটিতে মায়েদের ডাটাসেট ছিল। হামাদানির গবেষণাটির স্টাডি এরিয়া ছিল চাঁদপুরের মতলব উপজেলা। অর্থাৎ গবেষণাটি সীমাবদ্ধ ছিল একটি উপজেলায় নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির কিছু মহিলা ও শিশুর মধ্যে।  

Screenshot source: JD Hamadani Research

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ২০০৫ সালের ২৫ আগস্ট এক প্রতিবেদনে জানায়, “উত্তর আয়ারল্যান্ডের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক রিচার্ড লিন সে বছর যৌথ এক গবেষণায় বলেন, নারীদের থেকে পুরুষের আই-কিউ বেশি। তিনি বলেন, পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের গড় আইকিউ ইউরোপীয়দের তুলনায় বেশি।”

২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল বিবিসির আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উক্ত গবেষণায় বিতর্কিত তথ্য দেওয়ার কারণে লিনকে বর্নবাদী এবং যৌনতাবাদী প্রকৃতির আখ্যা দিয়ে তার ইমেরিটাস পদবী বাতিল করে আলস্টার কর্তৃপক্ষ।

ইমেরিটাস একটি সম্মানজনক পদবী। এটি সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদদের দেওয়া হয়। লিন আলস্টারে শিক্ষকতা করেননি। তাকে শুধু এই স্বীকৃতি হিসেবে উপাধিটি দেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালে psych জার্নালে আইকিউ বিষয়েই প্রকাশিত রিচার্ড লিনের একটি পেপার নিয়েও বিতর্ক শুরুর পর এর মাস চারেক পর জার্নাল কর্তৃপক্ষ জানায়, “পেপারটির বিষয়বস্তু এমন একটি বিষয়কে প্রতিনিধিত্ব করে যা অত্যন্ত বিতর্কিত এবং আমরা স্বীকার করি যে লেখক বহু বছর ধরে এই ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।” জার্নাল কর্তৃপক্ষ বলেন, “একজন প্রকাশক হিসেবে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়াতে চাই না, তবে আমরা বিশ্বাস করি যে সেগুলোকে একটি বৈজ্ঞানিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে উপস্থাপন করা উচিত।”

অর্থাৎ, আইকিউ বিষয়ক গবেষণায় রিচার্ড লিন বরাবরই একজন বিতর্কিত গবেষক হিসেবে সমালোচিত হয়ে আসছেন।

এ বিষয়ে জানতে রিচার্ড লিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে সাড়া মেলে নি।

আইকিউ পরীক্ষা প্রথাটাই বিতর্কিত?

যদিও আইকিউ পরীক্ষা প্রথা প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলছে, কিন্তু এই পদ্ধতিটি সবসময়ই একটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং ত্রুটিপূর্ণ নকশা সামনে এনেছে। বুদ্ধিমত্তা একটি বিমূর্ত ধারণা হওয়ায় বুদ্ধিমত্তা শ্রেণীবদ্ধ করার পদ্ধতি নিজেই একটি সাধারণ অভিযোগ হিসেবে পরিগণিত হয়।

গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে আইকিউ পরীক্ষার পরিসংখ্যানগত বৈধতায় ঘাটতি রয়েছে কারণ একই পরীক্ষা বারবার নেওয়ার সময় যে কোনও ব্যক্তি ভিন্ন ফলাফল তৈরি করবে। একইসাথে, আইকিউ পরীক্ষাগুলো শুধুমাত্র তরল বুদ্ধিমত্তার উপর ফোকাস করে (যা কেবল টাস্ক-ভিত্তিক) এবং আমাদের স্ফটিক বুদ্ধিমত্তাকে উপেক্ষা করে (যা আমরা জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংগ্রহ করি)। এই কারণে, আইকিউ পরীক্ষাকে অসম্পূর্ণ, অবাস্তব এবং আংশিকভাবে অবৈধ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ বার্কলে’র সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্টিভেন পিয়ানটাডোসি বলছেন,” কারো আইকিউ স্কোর প্রসঙ্গের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন হতে পারে। আপনি যদি কম চেষ্টা করেন তবে আপনি উচ্চ স্কোর করতে যাচ্ছেন না। অথবা, যদি আপনি কৌশলগুলো না জানেন যা লোকেরা করে, আপনি তাদের মতো উচ্চ স্কোর করতে পারবেন না।”

তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি এটি বলা একটি ভুল যে আপনার সত্যিকারের ক্ষমতা আপনি কতটা পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক তার দ্বারা নির্ধারিত হবে।”

Screenshot source: Discover

নিউ জার্সির রাইডার বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ স্টিফান সি. ডোমব্রৌসকি  এবং ওহাইও স্ট্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিষয়ক মনোবিদ ডোন্না ওয়াই. ফোর্ড মনে করেন, “আইকিউ পরীক্ষা এখনও পুরো ব্যক্তির সামগ্রিক মূল্যায়নের একটি অংশ হিসাবে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু ব্যবহারকারী শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে যে পরীক্ষাগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং ভালোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।”

মনোবিজ্ঞানীদের চোখে আইকিউ

আইকিউ বিষয়ে আলাপ করতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ বার্কলে’র সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্টিভেন পিয়ানটাডোসি’র সাথে যোগাযোগ করেছিল রিউমর স্ক্যানার। আইকিউ কার্যকর কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, “এগুলো জীবনের কিছু ফলাফল যেমন আপনার আয়, শিক্ষা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত। অনেকে বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষায় পারফরম্যান্স এবং জীবনের ফলাফলের মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে কি না সেটি নিয়েই সন্দেহ করে। “

অধ্যাপক পিয়ানটাডোসি বলেছেন, “আইকিউ পরীক্ষা কোনোভাবেই একজন ব্যক্তির প্রকৃত যোগ্যতা মূল্যায়ন করে না।”

Steven Piantadosi. Source: UCB

পিয়ানটাডোসি মত দিয়েছেন, বৈশ্বিক আইকিউ র‍্যাংকিং একটি অস্বীকার্য বাজে কথা ছাড়া আর কিছু না। তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশে শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে ভিন্নতা রয়েছে, তাই অবশ্যই তারা কিছু পরীক্ষায় ভিন্ন পারফরম্যান্স করে। নির্দিষ্ট আইকিউ প্যাটার্ন থেকে তাই প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না।”

রিচার্ড লিনের গবেষণা এবং আইকিউ সম্পর্কিত বিষয়ে জানতে London School of Hygiene & Tropical Medicine এর বিবর্তনীয় জনসংখ্যাবিদ এবং নৃতত্ত্ববিদ ডাঃ রেবেকা সিয়ারের সাথে যোগাযোগ করেছিল রিউমর স্ক্যানার।

লিনের গবেষণার বিষয়ে প্রকাশিত তার রিভিউর মতামত পুনর্ব্যক্ত করে রেবেকা রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “লিনের ‘ন্যাশনাল আইকিউ’ ডাটা উদ্দেশ্যের জন্য উপযুক্ত নয় এবং বিশ্বব্যাপী জ্ঞানীয় ক্ষমতা কীভাবে পরিবর্তিত হয় তার একটি ইঙ্গিত হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি আংশিক কারণ যে পদ্ধতির দ্বারা ডাটাসেটটি তৈরি করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত।”

Rebecca Sear. Source : LSHTM

রেবেকার মতে, জ্ঞানীয় পরীক্ষাগুলো ডিজাইন করা অসম্ভব। তাই বিশ্বজুড়ে নির্ভরযোগ্য আইকিউ স্কোর সহ কোনো ডাটাসেট নেই।

মূলত, বুদ্ধিমত্তা নির্ণয়ে আইকিউ পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর থেকেই এটি ঘিরে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়ে আসছে। রিউমর স্ক্যানারের কাছে একাধিক আন্তর্জাতিক মনোবিজ্ঞানী আইকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। আইকিউ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা মার্কিন গবেষক রিচার্ড লিনও বেশ কয়েক বছর ধরেই বিতর্কিত হিসেবে সমালোচিত হচ্ছেন। অপর্যাপ্ত নমুনা, নির্দিষ্ট এলাকার জনসংখ্যা এবং নিজস্ব বিশ্বাস গবেষণায় প্রতিফলিত হওয়ায় তার আইকিউ বিষয়ক গবেষণাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। লিনের এমনই একটি গবেষণাকেই প্রধান সূত্র ধরে সম্প্রতি ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’ নামে একটি অখ্যাত ওয়েবসাইট আইকিউয়ের বৈশ্বিক র‍্যাংকিং প্রকাশ করেছে। এই র‍্যাংকিং নিয়েও তাই স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনা হচ্ছে। এই র‍্যাংকিংয়ে তথ্যগত বেশ কিছু ভুলও লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। তাই বলা যায়, এই র‍্যাংকিং বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে সক্ষম হয়নি।

সুতরাং, ডাটাসেটের অপর্যাপ্ততা, নিজস্ব বিশ্বাসের প্রতিফলনসহ নানা কারণে আইকিউ পরীক্ষা পদ্ধতি ও গবেষণা বরাবরই বিতর্কিত হিসেবে সমালোচিত হয়ে আসছে।

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img