বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়, পূর্ব সীমান্তে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণ উপকূলের দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। বাংলাদেশেরে পূর্বনাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ার পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। তবে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ নাম (পূর্ণরূপ) নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের তথ্য প্রচার হতে দেখা যায়।
“বাংলাদেশ নামের পূর্ণরূপ” তথ্যটির সূত্রপাত
অনুসন্ধানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “বাংলাদেশ নামের পূর্ণরূপ” তথ্যটির সূত্রপাত পাওয়া যায় ২০১০ সালের ৭ আগষ্ট থেকে। পরবর্তী বছরগুলোতে এই তথ্যটি ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগসাইট ও ভিডিও শেয়ারিং সাইটে ভিডিও কন্টেন্ট হিসেবে প্রচারিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ নামকণের ইতিহাস
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি’র বাংলা সংস্করণে ২০১৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, “বাংলা” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শব্দ “বঙ্গ” থেকে। আর্যরা “বঙ্গ” বলে এই অঞ্চলকে অভিহিত করতো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
তবে বঙ্গে বসবাসকারী মুসলমানরা এই “বঙ্গ” শব্দটির সঙ্গে ফার্সি “আল” প্রত্যয় যোগ করে। এতে নাম দাঁড়ায় “বাঙাল” বা “বাঙ্গালাহ্”। “আল” বলতে জমির বিভক্তি বা নদীর ওপর বাঁধ দেয়াকে বোঝাতো।
এছাড়াও, ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন; “মুসলমান শাসনামলে বিশেষ করে ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে এবং ১৫৭৬ সালে মোঘলরা বাংলা দখল করার পরে এই অঞ্চলটি বাঙাল বা বাঙালাহ নামেই পরিচিতি পায়।”
তবে বাংলা, বাঙাল বা দেশ এই তিনটি শব্দই ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। কোনটিই বাংলা শব্দ নয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা দখলদারিত্বের সময় এই বাংলাকে বিভিন্ন নাম দেন। শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাও বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের মতো কয়েকটি প্রেসিডেন্সি নিয়ে নাম দিয়েছিলেন “বঙ্গ”। ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের নাম হয় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি।
এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় গোটা বাংলায় একটা প্রশাসনিক বিভাজন হয়। বাংলার পশ্চিম অংশ হয়ে যায় পশ্চিম বঙ্গ এবং পূর্ব অংশ হয়ে যায় পূর্ব বাংলা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ১৯৪৭ সালে বঙ্গ-প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হল। সে সময় পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নাম দিতে চাইলো পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু এ নিয়ে সেই সময় থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা।
এরপর ১৯৫৭ সালে করাচীতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় “পূর্ব পাকিস্তান” নামটির প্রতিবাদ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। যারা স্বাধীনতার পক্ষে চিন্তাভাবনা করতো। তারা এই অঞ্চলকে বলতেন স্বাধীন পূর্ব বাংলা।
এরপর আসে ১৯৬৯ সাল। শুরু হয় আইয়ূব পতন আন্দোলন। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে স্লোগান দেওয়া হয় “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।”
ইতিহাস অনুযায়ী, ওই প্রথম পূর্ব বাংলাকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হয়। পরে ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, “আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ”। এই নাম দেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে “বাংলা”, এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দেশ। এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে “বাংলাদেশ” নামকরণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের খবর ছাপা হয়। এরপরও নথিপত্র-গুলোয় পূর্ব পাকিস্তান লিখতে হলেও কেউ মুখে পূর্ব পাকিস্তান উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন বাংলাদেশ। সেই থেকে এই দেশকে আর কেউ পূর্ব পাকিস্তান বলেনি। সবাই বাংলাদেশ হিসেবেই মনে-প্রাণে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে জানান ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
তারপর মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে – তাতেও বলা হয় এই দেশটির নাম হল “বাংলাদেশ”। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি তারবার্তা পাঠান। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রেও ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত হওয়া অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের নানা ঘোষণাপত্রে ‘বাংলাদেশ’ ব্যবহৃত হয়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভ করলে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ নামকরণ হয়। এরপর ১৯৭২ এর ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সেই সময়ও দেশটির সাংবিধানিক নাম দেয়া হয় “বাংলাদেশ“। এর মাধ্যমে হাজার বছরের পথচলা সমাপ্তি হয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামক সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম লাভ করে।
‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ এর অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যীশু খ্রিস্টের জন্মের বহু আগে ল্যাটিনদের নানা রচনাতে ‘গঙ্গারিডি’ নামের প্রচলন দেখা যায়। তারা ভ্রমণকালে এসব উল্লেখ করে থাকতে পারে। বিশেষত, ঐতিহাসিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের বিখ্যাত ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে আমরা গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ঘটনার বিবরণ পাই। সেখানে তিনি বলেছেন আলেকজান্ডার প্রায় সমগ্র পৃথিবী জয় করে ফেললেও ‘গঙ্গারিডাই’ আক্রমন পর্যন্ত করেননি। এছাড়া টলেমিসহ অন্যান্য গ্রীক ঐতিহাসিকদের বহু রচনায় এই শব্দের উল্লেখ আছে।
প্রাচীন রচনাবলিতে গঙ্গা, গঙ্গারিডাই ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতভেদ থাকলেও বঙ্গ শব্দটি নিয়ে খুব বেশি মতানৈক্য নেই। ‘রিয়াজ-উস-সালাতিন‘ গ্রন্থে গোলাম হোসেন সলিম ‘বঙ্গের’ ইতিহাস বর্ণনা করেছেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোনে। তার মতে, নূহ (আ.) নবীর আমলে মহাপ্লাবনের পরে পৃথিবীজুড়ে তাঁর পুত্রসহ ৮০ জন নরনারী বংশবিস্তারের কাজে নিযুক্ত হন। এশীয় ভূখন্ডে তাঁর পুত্রত্রয় সিন্ধ, হিন্দ এবং বঙ্গের নামানুসারে যথাক্রমে সিন্ধু, হিন্দুস্থান এবং বঙ্গের নামকরণ হয়।
বিডিনিউজনেট এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ বা ইসা নবীর জন্মের ১৫০০ বৎসর আগে ”ভঙ্গ বা বঙ্গ রাজ্য” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।
এছাড়াও, হিন্দু ধর্মানুযায়ী এই নামকরণের বিষয়ে নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। তাদের পৌরাণিক কাহিনিতে অঙ্গ, বঙ্গ, পুন্ডের কথা পাওয়া যায়। পৌরাণিক মতে রাজা বালি’র তিন পুত্র ছিল অঙ্গ, বঙ্গ ও পুন্ড্র নামে। অঙ্গ- পশ্চিমবঙ্গ , খুলনা , বরিশাল অঞ্চল ; বঙ্গ- ঢাকা , ময়মন্সিহ , ত্রিপুরা অঞ্চল ; পুন্ড্র- উত্তরবঙ্গ , আসাম অঞ্চল শাসন করতেন ।
বাংলা সাহিত্যে বঙ্গ ও বাংলাদেশের নাম
উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে “বঙ্গদেশ” বা “বাংলাদেশ” বলা হতো।বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে “বঙ্গদেশ” শব্দের উল্লেখ আছে। কাজী নজরুল ইসলাম তিরিশের দশকে তার কবিতায় “বাংলাদেশ” নামটি ব্যবহার করেছেন। আবার সত্যজিতের চলচ্চিত্রেও উচ্চরিত হয়েছে “বাংলাদেশ” নামটি। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে আখ্যায়িত করেছেন “সোনার বাংলা” বলে আর জীবনানন্দ দাস বলেছেন “রূপসী বাংলা“।
বাংলাদেশ নামের (ইংরেজিতে) কি কোনো পূর্ণরূপ আছে
বাংলাদেশ নামটি যেহেতু বাংলা ভাষা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু এর ইংরেজি শব্দ (Bangladesh) নামকরণের ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্ব বহন করেনি। এছাড়াও, অনুসন্ধানে ইতিহাসে, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ (Bangladesh) শব্দের পূর্ণরূপ পাওয়া যায়না। এটি পরবর্তীতে বর্ণের সাথে মিলিয়ে কেউ একজন সৃষ্টি করেছেন।
সুতরাং, বাংলাদেশ নামকরণের একটি গৌরবোজ্জল ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এর ইংরেজি শব্দ Bangladesh এর স্বীকৃত কোনো পূর্ণরূপ নেই। Bangladesh নামের যে সকল পূর্ণরূপ ইন্টারনেটে পাওয়া যায় সেগুলো পরবর্তীতে বর্ণের সাথে মিলিয়ে কেউ একজন তৈরি করেছে এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- BBC: বাংলাদেশের নাম কীভাবে ‘বাংলাদেশ’ হল?
- Tbs News: ‘বাংলাদেশ’ নামটি কীভাবে এলো?
- Bdnews24: ২৬ মার্চ, ১৯৭১: স্বাধীনতার ঘোষণা
- Bdnewsnet: বাংলাদেশের নামকরণের ইতিহাস