জাতিসংঘ শেখ হাসিনাকে বিশ্বের সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেনি

সম্প্রতি “জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত বিশ্বের প্রথম সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ বিশ্বের সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা দেয়নি বরং ‘Thetoptens’ নামের একটি সামাজিক যোগাযোগ সাইটের সূত্রে প্রায় একই ধরণের একটি তথ্যটি ২০১৮ সাল থেকে ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।

২০১৮ সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে
২০১৯ সালে সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে
২০২০ সালে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে
২০২১ সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে। 

গুজবের সূত্রপাত

ফেসবুকের নিজস্ব মনিটরিং টুলস ব্যবহার করে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ ‘Monitorbd.news’ (আর্কাইভ) নামের একটি ওয়েবসাইটে সর্বপ্রথম “এবার নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকের তালিকায় প্রথম হলেন শেখ হাসিনা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এই পোর্টালটিতে প্রবেশ করা যায়নি।

তবে পরবর্তীতে bdtoday.net নামের একটি ওয়েবসাইটে একইদিনে “এবার নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকের তালিকায় প্রথম হলেন শেখ হাসিনা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়।

এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট একনায়ক তথা স্বৈরাশাসকের তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জার্মানির নিকৃষ্ঠ স্বৈরশাসক এডলফ হিটলারকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান অর্জন করেন তিনি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও জনপ্রিয় জরিপভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘দি টপটেনস’ এ একটি দীর্ঘমেয়াদী জরিপের মাধ্যমে সেরা স্বৈরাশাসক নির্বাচিত হন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

এই প্রতিবেদনটির সূত্র ধরে ‘দি টপটেনস.কম’ (thetoptens.com) নামের ওয়েবসাইটটিতে Top 10 Worst Dictators in History‘ নামের একটি তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই তালিকাটি থেকে দেখা যায়, প্রায় ১২ বছর আগে এই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। OzzyVanHalen নামের যুক্তরাষ্ট্রের একজন ব্যবহারকারী এই জরিপ টি চালু করেন।

‘Top 10 Worst Dictators in History’ শিরোনামে OzzyVanHalen এর এই তালিকায় ২২৯ জনের নাম রয়েছে এবং এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এই তালিকায় মোট ভোট পড়েছে ২৫ হাজার। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কমেন্ট পেয়েছেন প্রায় ২২১৩টি, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন  এডলফ হিটলার, কমেন্ট পেয়েছেন ২৫৯ টি।

এছাড়া একই ওয়েবসাইটে “Top 10 Dictators In History” শীর্ষক শিরোনামে আলাদা আরেকটি তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় ৮ বছর আগে তৈরি করা এই তালিকায় নাম রয়েছে ৫২ জনের৷ তালিকায় মোট ভোট পড়েছে ৯০০ টি।

এই তালিকায় শীর্ষ দশে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছেন যথাক্রমে জার্মানির এডলফ হিটলার, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জোসেফ স্ট্যালিন ও চীনের মাও সেতুং। 

পরবর্তীতে Toptens ওয়েবসাইটটি সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায়, ওয়েবসাইটটি ২০০৫ সাল থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। যেটি ব্যবহারকারীদের পারস্পরিক অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়৷ ওয়েবসাইটটির সংগ্রহে ২ লাখের বেশি বিভিন্ন বিষয়ে শীর্ষ দশের তালিকা রয়েছে। যেখানে যে কেউ ভোট দেওয়া, শীর্ষ দশের তালিকা তৈরি করা, তালিকায় কোনো কিছু যোগ করা ও পুনরায় সাজানো সহ নানা কাজ  করতে পারেন৷

অপরদিকে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান যাচাই ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ “শেখ হাসিনাকে সেরা স্বৈরশাসকের তালিকায় নির্বাচিত করা হয়েছে?” শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনটিতে Toptens সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, “দি টপটেনস.কম (thetoptens.com) এমন কোন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ওয়েবসাইট নয়, যারা বিভিন্ন সময় গবেষণা উদ্দেশে এরকম জরিপ করে থাকে। এটি মূলত একটি সামাজিক যোগাযোগ সাইট যেখানে যে কেউ তার পছন্দ মত বিষয় নিয়ে জরিপ শুরু করতে পারে এবং অনুরূপ জরিপে ভোট দিতে পারে। এমনকি এই জরিপে অংশগ্রহণের জন্য কোন ব্যক্তিকে এই ওয়েবসাইটে একাউন্টও খুলতে হয় না। যেকেউ নির্দিষ্ট সময় পরপর এই ওয়েবসাইটে গিয়ে ভোট দিয়ে আসতে পারে।”

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানেও দেখা যায়, সাইটটিতে একাউন্ট না খুলেও যেকোনো বিষয়ে ভোট দেওয়া এবং একইসাথে ভোট সরিয়েও নেওয়া যায়। অর্থাৎ ওয়েবসাইটটি একটি সাধারণ উন্মুক্ত প্লাটফর্ম।  এখানে যে কেউ শীর্ষ দশের তালিকা তৈরি করা, একাউন্ট খোলা ছাড়াও ভোট দেওয়া, তালিকায় কোনো কিছু যোগ করা ও পুনরায় সাজানো সহ নানা কাজ  করতে পারেন৷

অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বের সেরা প্রথম সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে।

কিন্তু অনুসন্ধানে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটেও এ জাতীয় কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া জাতিসংঘ কখনো এ ধরনের তালিকা প্রকাশ করেছে এমন কোনো তথ্যও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মূলত, দি টপটেনস.কম (thetoptens.com) নামের একটি সামাজিক যোগাযোগ সাইটের জরিপকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কিছু অখ্যাত অনলাইন পোর্টালে বিশ্বের প্রথম সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, দি টপটেনস.কম কোনো বিশ্বস্ত জরিপ প্রতিষ্ঠান না৷ বরং এটি একটি সাধারণ উন্মুক্ত প্লাটফর্ম।  এখানে যে কেউ শীর্ষ দশের তালিকা তৈরি করা, একাউন্ট খোলা ছাড়াও ভোট দেওয়া, তালিকায় কোনো কিছু যোগ করা ও পুনরায় সাজানো সহ নানা কাজ  করতে পারেন৷ অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে বিশ্বের সেরা প্রথম সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে জাতিসংঘের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু অনুসন্ধানে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটেও এ জাতীয় কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়লে সেটিকেও মিথ্যা হিসেবে শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ বিশ্বের সেরা স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা দিয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img