সবচেয়ে বড় জুলুসের স্বীকৃতির জন্য গিনেজে আবেদনের দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি “বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুস’ স্বীকৃতি পেতে গিনেজে আবেদন” শীর্ষক শিরোনামের একটি তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

যা দাবি করা হচ্ছে

গত ৬ অক্টোবর জাতীয় দৈনিক The Daily Star এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, “ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে চট্টগ্রামে আয়োজিত জশনে জুলুসকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুস হিসেবে রেকর্ড বইয়ে নাম তুলতে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে জুলুস আয়োজনকারী সংস্থা আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৯ অক্টোবর চট্টগ্রামে জশনে জুলুস পর্যবেক্ষণ করবে গিনেজ বুক অফ ওয়াল্ড রেকর্ডের ম্যানেজমেন্ট টিম, এমনটাই জানিয়েছেন ট্রাস্টের মহাসচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।”

একই দাবিতে গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন দেখুন – ডেইলি স্টার ইংরেজি (আর্কাইভ), বাংলা ট্রিবিউন (আর্কাইভ), দৈনিক আজাদী (আর্কাইভ), বাংলাদেশ জার্নাল (আর্কাইভ), নিউজ বাংলা (আর্কাইভ), যমুনা টিভি (আর্কাইভ), সময়ের আলো (আর্কাইভ), নাগরিক টিভি (আর্কাইভ), ভোরের কাগজ (আর্কাইভ), একাত্তর টিভি (আর্কাইভ), আলোকিত বাংলাদেশ (আর্কাইভ), দৈনিক পূর্বকোণ (আর্কাইভ), বাংলাভিশন (আর্কাইভ), ঢাকা টাইমস (আর্কাইভ), বাংলাদেশ টুডে (আর্কাইভ), আমার সংবাদ (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত কিছু ভিডিও দেখুন এখানে এবং এখানে। 
ভিডিওগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে।

একই দাবিতে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ঈদে মিলাদুন্নবীতে চট্টগ্রামের জশনে জুলুসকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুসের স্বীকৃতি পেতে গিনেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার দাবিটি সঠিক নয় এবং ৯ অক্টোবর গিনেজ কমিটির জুলুসটি পর্যবেক্ষণের দাবিটিও মিথ্যা বরং ২০২৩ সালে গিনেজে এই আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছে জুলুসের আয়োজকরা।

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, মূল ধারার গণমাধ্যম Channel 24 এর অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে গত ৮ অক্টোবর জসনে জুলুশ: গিনেস বুকে স্থান পেতে জোর চেষ্টা শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “চট্টগ্রামে আয়োজিত জশনে জুলুসকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুস হিসেবে রেকর্ড বইয়ে নাম তুলতে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার প্রক্রিয়া চলছে। এই জুলুসের আয়োজক আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। প্রতিবেদনে ট্রাস্টের মিডিয়া উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, এটা গিনেজ বুকে যখন স্থান পাবে তখন এমন একটা নির্মল সংস্কৃতির খবর সারা পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে।” 

প্রতিবেদনে এই জুলুসের বিষয়ে ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ গিনেস রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে এবং ৯ অক্টোবর গিনেজ কমিটি জুলুস পর্যবেক্ষণে আসবে এমন কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। 

পরবর্তীতে মূল ধারার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে (প্রথম আলো, আমাদের সময়, বিডি নিউজ, আজকের পত্রিকা, নয়া দিগন্ত) এ জুলুস সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও গিনেজ রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনের বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কী বলছে গিনেজ কর্তৃপক্ষ?

বিশ্বের সবচেয়ে বড় জসনে জুলুস বিষয়ে পূর্বের কোনো রেকর্ড রয়েছে কি না সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংস্থাটির জনসংযোগ নির্বাহী অ্যালিনা পলিয়ানস্কায়া (Alina Polianskaya) রিউমর স্ক্যানারকে জানান,

“আমরা সবচেয়ে বড় জসনে জুলুস শিরোনামের কোনো রেকর্ড নিরীক্ষণ করি না” 

অর্থাৎ, গিনেজ রেকর্ডে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জসনে জুলুস সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডের ক্যাটাগরি নেই।

কী জানিয়েছে আয়োজকরা?

জাতীয় দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ এর গত ৯ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আনজুমান-এর রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের বরাতে বলা হয়, “আমাদের সংস্থার আশেক ভাইয়ারা আবেদন করেছে বলে আমি জানতে পারি এবং আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ রোববার জশনে জুলুছ পর্যবেক্ষণ করবে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের ম্যানেজমেন্ট টিম। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী গিনেজ বুক কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণ টিম গতকাল শনিবার চট্টগ্রামে আসেন এবং আজ তারা জশনে জুলুছ সরাসরি পর্যবেক্ষণ করবেন। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, এবারের ৫০তম জুলুসে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। একই সঙ্গে গিনেজ বুক কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণ টিমের জন্য তাদের তদারকি আরও দ্বিগুণ হয়ে গেছে।”

একই তথ্য একাধিক গণমাধ্যমে ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের বরাতে প্রকাশ হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে তাই সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “আমরা এখনও গিনেজ রেকর্ডে আবেদন করিনি আর গিনেজ রেকর্ডের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষণে আসার ব্যাপারে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এটা ভুল কথা।”

গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “আমি সরাসরি এমন বলিনি। ফেসবুক থেকে বা আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন তথ্য কেউ আমার নামে ছড়িয়ে থাকতে পারে।”

জনাব আনোয়ার জানান, ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ২০২৩ সালে তারা গিনেজ রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবেন।

গিনেজে কি নতুন ক্যাটাগরি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব?

গিনেজ রেকর্ড কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার পর রিউমর স্ক্যানার টিম অধিকতর অনুসন্ধানে গিনেজের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত কোনো ক্যাটাগরি খুঁজে পায়নি। তবে কেউ চাইলে নতুন ক্যাটাগরিতে রেকর্ডের জন্য আবেদন করতে পারে।

আবেদন করার পর যাচাই বাছাই শেষে গিনেজ কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীর নিকট রেকর্ড সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠায়। গিনেজ কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা পাঠানোর পূর্বে রেকর্ড করতে নিষেধ করেছে। নির্দেশনা অনুসরণ না করলে এবং অপর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকলে রেকর্ড অনুমোদন পাবে না বলেও জানানো হয়েছে গিনেজের ওয়েবসাইটে।

মূলত, গত ৯ অক্টোবর ঈদে মিলাদুন্নবীতে চট্টগ্রামে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত হয় জশনে জুলুস। এই জুলুসকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুলুস হিসেবে রেকর্ড বইয়ে নাম তুলতে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা এবং এর প্রেক্ষিতে ৯ অক্টোবর গিনেজ টিম চট্টগ্রামে জশনে জুলুস পর্যবেক্ষণ করেছে দাবি করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, তারা গিনেজের কাছে আবেদন করেননি এবং ৯ অক্টোবর গিনেজ টিমও আসেনি। তারা ২০২৩ সালে আবেদন করবেন বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ রবিউল আউয়াল আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম নগরীতে এ জশনে জুলুস অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আয়োজকদের দাবি, এবছরের ৫০তম এ জুলসে ৫০ লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৫৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দ্য গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড’ বইটি। এরপর থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশ্ব রেকর্ডধারীদের বিষয়ে বইটি প্রকাশিত হয়ে আসছে।

সুতরাং, সবচেয়ে বড় জুলুসের স্বীকৃতির জন্য গিনেজে আবেদনের দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img