বিগত কয়েক বছরে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল ঘন ঘন বন্যার কবলে পড়ছে। এই আকস্মিক বন্যার কারণ হিসেবে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত ‘অলওয়েদার সড়ক’ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক) কে দায়ী করছেন, কেউবা সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটকে, আবার কেউ ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে অতিবৃষ্টির পানিকে।
সম্প্রতি সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল আবারও বন্যা কবলিত হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে যে, ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়েছে এবং এই বাঁধ খুলে দেওয়ায় সিলেটে বন্যা হচ্ছে।
দাবিকৃত পোস্টে বলা হয়েছে, “প্রশ্ন : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল বলতে কি বুঝেন ?
উত্তর : ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ সহ মেঘালয়ের বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ তৈরি করে স্লুইস গেট দিয়ে পানি আটকে রাখা হয়। সেখানে অতিরিক্ত পানি জমে গেলে হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়ার ফলে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, সারী, লোভা, পিয়াইন চেলা নদীগুলোর মাধ্যমে যে ঢল নামে তাকে উজানের পাহাড়ি ঢল বলে। তবে এটাকে দাদা বাবুদের আশির্বাদও বলতে পারেন!”

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ এখনো নির্মিত হয়নি বরং এটি প্রস্তাবিত একটি প্রকল্প, যা বিভিন্ন প্রতিবাদের কারণে স্থগিত রয়েছে। আলোচিত দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বাঁধের ছবিটি মূলত শ্রীলঙ্কার ভিক্টোরিয়া বাঁধের ছবি।
দাবিকৃত পোস্টগুলোয় একটি বাঁধের ছবি এবং গুগল ম্যাপের একটি স্ক্রিনশট দিয়ে বানানো এক কোলাজ ছবি প্রচার করতে দেখা যায়।
কোলাজে থাকা বাঁধের ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে, ২০২২ সালের ২৬ জুন ‘Bioscope Entertainment’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে “টিপাইমুখ বাঁধ : বাংলাদেশের জন্যে আরেক মরণ ফাঁদ !! Tipaimukh Barrage” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ইউটিউব ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির থাম্বনেইলে একই কোলাজ ছবি ব্যবহৃত হয়েছে।

সম্পূর্ণ ভিডিওটির কোনো অংশে বলা হয়নি টিপাইমুখ বাঁধ ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়েছে বরং ভিডিওজুড়ে বলা হয়েছে, “টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর একটি প্রস্তাবিত বাঁধ। টিপাইমুখ বাঁধের উদ্দেশ্য হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন। প্রকল্পটি অগ্রসরের সাথে সাথে বারবার বিলম্বের শিকার হয়েছে, কারণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির অধিকার নিয়ে অমীমাংসিত কিছু বিষয় রয়েছে। পাশাপাশি বিশাল এ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের প্রশ্নটিও জড়িয়ে আছে। এছাড়াও কয়েকটি বিশাল জলাধার নির্মাণের জন্য আদিবাসী হামার লোকদের পুনর্বাসন করার প্রয়োজন রয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ শুধু আসামের বিশাল জনগোষ্ঠীর একক সমস্যা নয়, এই বাঁধ বাংলাদেশের জন্যও এক মরণ ফাঁদ।”
ভিডিওটির কোনো অংশে বাঁধটি ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে না বলা হলেও, থাম্বনেইলে একটি বাঁধের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে দর্শকের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে, কারণ শিরোনাম আর থাম্বনেইল দেখে কেউ মনে করতে পারে টিপাইমুখ বাঁধ ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়েছে এবং থাম্বনেইলের ছবিটি সেই বাঁধের।
পরবর্তীতে উক্ত থাম্বনেইলে ব্যবহৃত ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে, ফিচার কনটেন্ট প্ল্যাটফর্ম রোর মিডিয়ার ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একই ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, এটি শ্রীলঙ্কার ভিক্টোরিয়া বাঁধের ছবি। গুগল ম্যাপ এবং একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে (১,২) থাকা ভিক্টোরিয়া বাঁধের অসংখ্য ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আলোচিত ছবিটি ভিক্টোরিয়া বাঁধের।

অপরদিকে একই ছবিতে থাকা গুগল ম্যাপের টিপাইমুখ বাঁধ নামের স্থানের অনুসন্ধান করে একই নামে একটি লোকেশন পাওয়া যায়। তবে গুগলে ম্যাপের সেই স্থানে কোনো অবকাঠামো পাওয়া যায়নি। কেবল নামই দেখা যাচ্ছে সেখানে।
গুগল ম্যাপে থাকা টিপাইমুখ বাঁধের লোকেশনের সাথে জনপ্রিয় কিছু বাঁধের তুলনামূলক পার্থক্য করলে সেখনা বাঁধের অবকাঠামো দেখা যায় (১,২), কিন্তু টিপাইমুখ বাঁধের গুগল লোকেশনে কোনো অবকাঠামো দেখ যায় না।

এছাড়া আলোচ্য গুগল ম্যাপের স্ক্রিনশটে একটা বাঁধের ছবি দেখা যায়। সে বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, বাঁধের এই ছবিটি আলাদাভাবে এডিট করে বসানো হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে একটি বাঁধের গ্রাফিক ছবি সংগ্রহ করে বসানো হয়েছে। গ্রাফিক রিসোর্স প্রদানকারী পিএনজিট্রি ওয়েবসাইটে মূল গ্রাফিক ছবিটি পাওয়া যায়।

টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে পরিবেশ বিষয় সাংবাদিকতা সংস্থা ডায়ালগ আর্থের ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদন থেকে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে জানানো হয়, “টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পটি ভারতের মণিপুর রাজ্যে অবস্থিত। এটি বারাক নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ১,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটি ভারতের পরিবেশগত ক্ষতি এবং বাংলাদেশের কৃষির উপর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। পরিবেশবিদ ও কৃষকরা আশঙ্কা করছেন যে, এটি জলপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটাবে ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করবে। প্রকল্পটিকে বর্তমানে স্থগিত রাখা হয়েছে।”
২০১৭ সালে অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “তৎকালীন বাংলাদেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সংসদে জানিয়েছেন ভারত তিপাইমুখ প্রকল্পের প্রাথমিক আকার ও নকশা পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করছে। বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষতির কথা বিবেচনা করে এই পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, যৌথ সমীক্ষা চলছে যাতে প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করা যায়। ভারত প্রকল্পের প্রাথমিক নকশায় পরিবর্তন আনার বিষয়ে বাংলাদেশকে অবহিত করেছে এবং নতুন তথ্য পাওয়ার পর সমীক্ষা চূড়ান্ত হবে।
টিপাইমুখ প্রকল্পটি বারাক নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করে মণিপুর রাজ্যে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আসাম রাজ্যে সেচের জন্য পরিকল্পিত। তবে এই প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলসহ অন্যান্য স্থানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
ভারত এই প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা বিবেচনা করে পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছে।”
ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) এর ওয়েবসাইটে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, “টিপাইমুখ হল বৃহত্তম বাঁধ প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি। ২০০৮ সালের দিকে স্থানীয় প্রতিবাদ এবং ভারতের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বন উপদেষ্টা কমিটির (FAC) প্রত্যাখ্যানের কারণে এটি স্থগিত হওয়ার আগে কিছু ক্ষুদ্র নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল।”
অর্থাৎ, টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পটি ভারতের মণিপুর রাজ্যে বারাক নদীর উপর প্রস্তাবিত একটি বাঁধ, যা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরিকল্পিত হলেও পরিবেশগত ক্ষতি ও বাংলাদেশের কৃষির উপর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কায় স্থগিত রয়েছে। উল্লিখিত কোনো সূত্রে এই বাঁধ ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া টিপাইমুখ বাঁধের কোনো ছবিও ভারতীয় সরকারি কোনো সূত্রে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি একাধিক গণমাধ্যমে টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে (১,২) একটি বাঁধের ছবি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
তবে উক্ত ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ট্রাভেলব্লগ নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০০৬ সালে প্রকাশিত একটি ব্লগ প্রতিবেদন একই ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটির বর্ণনা অনুযায়ী এটি চাম্বা বাঁধের ছবি।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবিটি মূলত ভারতের হিমাচল প্রদেশের চাম্বা অঞ্চলে রাভি নদীর উপর নির্মিত চামেরা বাঁধের। এই বাঁধের অন্যান্য ছবি ও ভিডিওর সাথে (১,২,৩) মিলিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় ছবিটি চামেরা বাঁধের।

মূলত, বিগত বছরে টিপাইমুখ বাঁধের ছবি দাবিতে চামেরা বাঁধের ছবি প্রচার করা হচ্ছে গণমাধ্যমে। কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত ‘অলওয়েদার সড়ক’ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক), সিলেট অঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকট, এবং ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে অতিবৃষ্টির পানি এই বন্যার জন্য প্রায়শই দায়ী করা হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে, ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে এবং ওই বাঁধ খুলে দেওয়ায় সিলেটে বন্যা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, টিপাইমুখ বাঁধ এখনো নির্মিত হয়নি, এটি একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প। এই দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত বাঁধের ছবিটি শ্রীলঙ্কার ভিক্টোরিয়া বাঁধের।
সুতরাং, ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত বিষয়টি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s own analysis.
- Roar – Hydroelectric power plants in Sri Lanka
- Google Maps – Victoria Dam
- Gettyimages – Elevated View of Victoria Dam and Reservoir
- Wikidata – Victoria Dam
- Pngtree – Water Dam Icon
- Dialogue Earth – Polls may stall India’s Tipaimukh dam again
- Bdnews24 – Bangladesh Minister says India may change ‘form and design’ of Tipaimukh project
- ORF – India-Bangladesh Trans-Boundary River Management: Understanding the Tipaimukh Dam Controversy
- Travelblog – Chamba Dam
- Wikipedia – Chamera Dam
- Justdial – Chamera Dam
- Alamy – Chamera I dam – which has formed the reservoir Chamera Lake – on the Ravi river near Chamba, Himachal Pradesh. IndiaYoutube – Chamera Dam Chamba Himachal Pradesh