গত জুলাই মাসের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে রুপ নেয়। গণআন্দোলনের মুখে গত ০৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। ০৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরমধ্যে দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অসংখ্য শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। দেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক শিক্ষক হেনস্তার খবর আসে গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরই প্রেক্ষিতে গাছের সাথে একজন নারীকে বেঁধে রাখার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, এক্স ও গণমাধ্যমে প্রচার করে দাবি করা হয়, “ঢাকার আজিমপুর গভঃমেন্ট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার পদত্যাগ করানোর জন্য শিক্ষিকাকে রশি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ।”

উক্ত দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।
উক্ত দাবিতে ভারতীয় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও পোস্ট করা হয়৷ এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ভারতীয় গণমাধ্যমেও উক্ত দাবিতে সংবাদ প্রচার করা হয়৷ এমন প্রতিবেদন দেখুন : দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ত্রিপুরা ইনফো।
উক্ত নারীকে শিক্ষক দাবিতে ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গাছের সাথে বেঁধে রাখা নারী আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়া নন, বরং ভিন্ন একজন নারী যিনি একজন সম্ভাব্য প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তাছাড়া, আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের আগে থেকেই শিক্ষিকা গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার পদত্যাগের দাবির ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে যেখানে সাম্প্রদায়িক কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের ফেসবুক পেজে উক্ত ঘটনার বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়৷ গাছের সাথে একজন নারীকে বেঁধে রাখার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির উক্ত ফেসবুক পেজ থেকে গত ২১ আগস্ট তারিখে একটি পোস্টের মাধ্যমে জানানো হয়, “কিছু মানুষ স্কুলের নামে মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে। শুধু তাই না কেউ কেউ তো হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের ও অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি,গাছের সাথে বেঁধে রাখা মানুষটা গীতাঞ্জলি বড়ুয়া না। স্কুলের কোনো শিক্ষক ও না। উনি নিজেকে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়(এইটার কোনো প্রমান ও পাওয়া যায় নি)। তখন উত্তেজিত ছাত্রীরা ওনাকে বেঁধে রাখে।(আমরা কোনো মেয়েকে গাছের সাথে বেঁধে রাখাও সমর্থন করছি না) ঘটনাটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।”
এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম আজকের পত্রিকার ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৯ আগস্ট তারিখে “শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকি, আজিমপুরে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে” শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়৷ ভিডিও প্রতিবেদনে উক্ত বেঁধে রাখা নারীর একটি ছবি বা স্থিরচিত্রও ব্যবহৃত হয়। উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষসহ দুইজন শিক্ষিকার পদত্যাগের দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার চেষ্টা করান অভিযুক্ত শিক্ষকরা৷ তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রাক্তন একজন শিক্ষার্থীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন।”
অর্থাৎ, উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা উক্ত নারীকে একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলে উল্লেখ করা হয়।

তাছাড়া, উক্ত একই প্রতিবেদনে আলোচিত শিক্ষিকা গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার ছবিও প্রকাশ করা হয় যার সাথে গাছের সাথে বেঁধে রাখা নারীর বৈসাদৃশ্য দেখা যায়।

এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে গত ২২ আগস্ট তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আলোচিত শিক্ষিকা গীতাঞ্জলি বড়ুয়া নিজেই দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে গাছের সাথে তাকে বেঁধে রাখার মর্মে প্রচারিত দাবিগুলো মিথ্যা বলে নিশ্চিত করেছেন। তিনি একইসাথে জানান যে তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, যেহেতু তার শিক্ষার্থীরা তাকে আর চাচ্ছিল না। তিনি তার পদত্যাগপত্র স্বেচ্ছায় জমা দিয়েছেন, কোনোরকমের বাইরের চাপ ছাড়াই।
তাছাড়া প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, গত ১৪ জুলাই তারিখে আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি উত্থাপন করে। দুর্নীতিগ্রস্থ হওয়ার অভিযোগে তারা তাৎক্ষণিকভাবে অফিস সহকারী সবুজ মিয়া, চিফ অ্যাসিস্টেন্ট মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং লেকচারার আব্দুর রহিমকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানায়। শিক্ষার্থীরা এছাড়াও স্কুল এবং সাবেক ঢাকা দক্ষিণ মেয়র ফজলে নূর তাপসের সাথে সম্পৃক্ত শফিকুল ইসলামের সাথে সব রকমের চুক্তি বাতিল করার দাবি জানায়।
অধ্যক্ষ এই অভিযোগগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান এবং উক্ত ব্যক্তিদের পদত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন। শিক্ষার্থীরা এজন্য তিনদিনের একটি আল্টিমেটাম দেয়।
১৮ জুলাই তারিখে আল্টিমেটামের সময় শেষ হলে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে এসে কিছু শিক্ষকদের সাথে বিবাদে জড়ায়। তারা প্রশ্নফাঁস, হয়রানি, হুমকি, কোচিং ব্যবসায় জড়ানো এবং অপমানের অভিযোগে শাহনাজ আক্তার, গৌতম চন্দ্র পাল এবং আব্দুর রহিম নামের আরো তিনজন শিক্ষকের পদত্যাগের দাবি জানায়। শিক্ষার্থীরা তাদের পদত্যাগের জন্য অধ্যক্ষকে চাপ দিতে থাকে। এরই মাঝে কিছু শিক্ষক ছয়জন বহিরাগতদের ডেকে আনেন এবং তারা শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছনা করে। তবে, বহিরাগতদের কারা ডেকেছে তা গীতাঞ্জলি বড়ুয়া জানেন না বলে তিনি জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের দাবি অধ্যক্ষ পূরণ করতে না পারায় এবং পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়ুয়ার পদত্যাগের দাবি জানায়।
উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনে গাছের সাথে বেঁধে রাখা নারীর পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গাছের সাথে বেঁধে রাখা উক্ত নারীর নাম নদী, যিনি ধর্মে একজন মুসলিম এবং একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
সুতরাং, মুসলিম ধর্মালম্বী ভিন্ন নারীকে গাছের সাথে বেঁধে রাখার ঘটনাকে আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের হিন্দু শিক্ষিকা গীতাঞ্জলি বড়ুয়াকে বেঁধে রাখার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Azimpur Govt. Girls School & College – Facebook Post
- Ajker Patrika – শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধামকি, আজিমপুরে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে
- The Business Standard – Was Azimpur Govt Girls’ School principal really tied to a tree?
- Rumor Scanner’s own analysis