শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে আড্ডার বিষয়ে সেনাবাহিনীর আইনগত ব্যবস্থার ঘোষণা সংক্রান্ত নোটিশটি ভুয়া

সম্প্রতি, বাংলাদেশ সেনবাহিনীর জরুরি নোটিশ দাবিতে বিজ্ঞপ্তির একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 

সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এর আদেশক্রমে দাবিকৃত উল্লেখিত জরুরি নোটিশে বলা হয়েছে, এতদ্বারা সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার যাওয়ার সময়/ ছুটির সময়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার আশেপাশে বা দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া এবং রাস্তা ঘাটে অহেতুক ঘোরাফেরা করা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হচ্ছে। ছাত্র ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা বাংলাদেশ army আজ থেকে যদি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার সামনে কোন বখাটে ছেলে পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হইবে।

সেনাবাহিনীর আইনগত

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বরাতে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এর আদেশক্রমে উল্লেখিত ‘স্কুল- কলেজের সামনে আড্ডা দেওয়া ও অহেতুক ঘোরাফেরা করা কোনো বখাটে ছেলে পাওয়া গেলে গ্রেফতার’ সংক্রান্ত প্রচারিত জরুরি নোটিশটি ভিত্তিহীন বা ভুয়া। একই নোটিশটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পুলিশের নামেও প্রচার হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকেও সারাদেশের জন্য এমন কোনো নোটিশ দেওয়া না হলেও বিভিন্ন সময় পৃথকভাবে কয়েকটি থানার পক্ষ থেকে এমন নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

এবিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ পর্যবেক্ষণ করে এমন কোনো নোটিশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

তবে, গতকাল (০১) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে উক্ত নোটিশটি ভুয়া উল্লেখ করে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) দেওয়া হয়। 

Screenshot: Bangladesh Army Facebook Post 

পোস্টে জানানো হয়, “নোটিশঃ এতদ্বারা সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, সম্মানিত সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এর পক্ষ হতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সংক্রান্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জরুরি নোটিশ নামক যে ফেসবুক পোস্টটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে/হচ্ছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অলীক। এ ব্যাপারে সর্বসাধারণকে সচেতন থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।”

গুজবের সূত্রপাত

অনুসন্ধানে ‘Army Wife’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপে গত ০২ এপ্রিল Miraj Hossen নামক একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে করা একটি পোস্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে আলোচিত বিজ্ঞপ্তির একটি স্ক্রিনশট সংযুক্ত রয়েছে।

Screenshot: Facebook Claim Post 

উক্ত স্ক্রিনশটটি “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী” নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া। কিন্তু, কি-ওয়ার্ড সার্চ করে সেই অ্যাকাউন্টটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের নাম বাংলায় নয় ইংরেজিতে এবং পেজটি ভেরিফায়েড করা।

অর্থাৎ, সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি কোনো নির্ভরযোগ্য ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা পেজ থেকে করা হয়নি।

এছাড়া, আলোচিত নোটিশে উল্লেখিত কার্যক্রমটি বেসামরিক প্রশাসনের আওতাধীন। স্বাভাবিকভাবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এমন কোনো নোটিশ প্রদানের সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ পুলিশের বরাতে একই নোটিশ সারাদেশে প্রযোজ্য দাবিতে প্রচার: 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই নোটিশ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ পুলিশের বরাতে প্রচার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পুলিশের বরাতে গত মার্চ মাসে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

পুলিশের বরাতে প্রচারিত নোটিশে দাবি করা হচ্ছে, এটি সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য বাংলাদেশ পুলিশের একটি নোটিশ। 

এবিষয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ পর্যবেক্ষণ করে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে চ্যানেল 24 এর অনলাইনে ২০২২ সালের ১০ জুন “স্কুল-কলেজের পাশে বখাটেদের পেলেই গ্রেপ্তার” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বখাটেদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডরো রোধে ও গণসচেতনতার লক্ষ্যে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানা পুলিশ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাঁটিয়ে দিয়েছেন সতর্কতামূলক পোস্টার।  

পুলিশের পক্ষ থেকে সাঁটানো কঠোর সর্তক বার্তায় লেখা রয়েছে, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা চলাকালীন বা ছুটি হওয়ার সময়ে যেকোনো স্কুলের পাশে ও দোকানে আড্ডা দেয়া এবং অহেতুক ঘোরাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ। ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আজ থেকে যদি কোনো স্কুল-কলেজ বা মাদরাসার সামনে বখাটে ছেলে পাওয়া যায় তাহলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

একই তথ্যে সংবাদ প্রকাশ করে ডেল্টা টাইমস। 

এছাড়া, একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তরে “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ঘোরাফেরা-আড্ডা নিষিদ্ধ!” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে বা দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া ও রাস্তাঘাটে অহেতুক ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পুলিশ। এ সংক্রান্ত একটি নোটিশ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গেটে টাঙানো হয়েছে।

নোটিশে লেখা রয়েছে- স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের আশপাশে বা দোকানে বসে আড্ডা দেওয়া ও রাস্তাঘাটে অহেতুক ঘোরাফেরা করা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আজ থেকে যদি স্কুল ও মাদ্রাসার সামনে বখাটে ছেলে পাওয়া যায়, তাদের গ্রেফতার করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই নোটিশে থানার ওসির মোবাইল নাম্বারও লেখা রয়েছে।

এরপর, গত বছরের ১২ জানুয়ারি জাগো নিউজ এর ওয়েবসাইটে “সোনারগাঁয়ে স্কুল-কলেজের পাশে বখাটে পেলেই গ্রেফতার” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধে ও গণসচেতনতা তৈরিতে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছে সোনারগাঁ থানা পুলিশ। এখন থেকে স্কুল-কলেজের পাশে বখাটে পেলেই গ্রেফতার করা হবে সতর্ক করে দিয়েছে পুলিশ ।

১১ জানুয়ারি সোনারগাঁ থানা পুলিশের ফেসবুক পেজে এ-সংক্রান্ত এক সতর্ক বার্তা দেখা গেছে।

সতর্ক বার্তায় লেখা রয়েছে, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা চলাকালীন বা ছুটি হওয়ার সময়ে যেকোনো স্কুলের পাশে ও পাশের দোকানে আড্ডা দেওয়া এবং অহেতুক ঘোরাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ। ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আজ থেকে যদি কোনো স্কুল-কলেজ বা মাদরাসার সামনে বখাটে ছেলে পাওয়া যায় তাহলে তাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অর্থাৎ, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা চলাকালীন বা ছুটি হওয়ার সময়ে যেকোনো স্কুলের পাশে ও পাশের দোকানে আড্ডা দেওয়া এবং অহেতুক ঘোরাফেরা করলে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়ার নোটিশটি পুলিশ সদরদপ্তর কর্তৃক ঘোষিত সারাদেশের জন্য নয় বরং নোটিশটি ২০২২ ও ২০২৩ সালে পৃথক পৃথক সময়ে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানা, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানা এবং নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় দেওয়া হয়।

একই নোটিশ দুই বাহিনীর বরাতে প্রচার 

বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশ পুলিশের বরাতে প্রচারিত জরুরি নোটিশ দুইটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, উক্ত নোটিশ দুইটি হুবহু একই রকম। সেনাবাহিনীর নামে প্রচারিত নোটিশে শুধু বাংলাদেশ ‘পুলিশ’ এর জায়গায় ‘army’ লেখা হয়েছে। 

Photo Comparison By Rumor Scanner 

মূলত, সম্প্রতি সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এর আদেশক্রমে উল্লেখিত জরুরি নোটিশের প্যাড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এমন কোনো নোটিশ দেয়নি। এছাড়া, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফেসবুক পেজ থেকেও এটি মিথ্যা বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ পুলিশের বরাতে প্রচারিত জরুরি নোটিশটি সারাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয় বরং এটি ২০২২ সালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থানা এবং গতবছর নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ থানা কর্তৃক স্ব স্ব থানার জন্য নোটিশটি জারি করা হয়েছিল।

সুতরাং, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে আড্ডা ও ঘোরাফেরা সংক্রান্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বরাতে প্রচারিত জরুরি নোটিশটি সম্পূর্ণ ভুয়া ও বানোয়াট।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img