ইসরায়েলি পণ্যের ভুয়া তালিকা ভাইরাল

সম্প্রতি ইসরায়েলি পণ্য দাবিতে বিভিন্ন ধরণের ৩৩ টি পণ্যের একটি তালিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে এসব পণ্য বয়কটের আহবান জানানো হচ্ছে। 

১৫ টি ক্যাটাগরির এই তালিকায় যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলো হলোঃ জুতার মধ্যে বাটা, শ্যাম্পুর মধ্যে ক্লিয়ার, সানসিল্ক, ডাভ, সাবানের মধ্যে লাক্স, ডাভ, লাইফবয়, টয়লেট্রিজ পণ্যের মধ্যে লরিয়াল,বস, গার্নিয়ার, ওয়াশিং পাউডারের মধ্যে সার্ফ এক্সেল, হুইল, রিন, ক্রিম বা বডি লোশনের মধ্যে ভ্যাসলিন, ডাভ, পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, বেবি লোশন জনসন অ্যান্ড জনসন, নুডলসের মধ্যে ম্যাগী, কোল্ড ড্রিংকস বা কোমল পানীয়র মধ্যে কোকাকোলা, পেপসি, স্প্রাইট,  ফান্টা, সেভেন আপ, অ্যাটম, অ্যাকুয়াফিনা, চায়ের মধ্যে তাজা, বডি স্প্রের মধ্যে এক্স, অ্যান্টি পারসপিরেন্ট পণ্য হিসেবে রেক্সোনা, পাউডারের মধ্যে পন্ডস, টুথপেস্ট হিসেবে পেপসোডেন্ট, ক্লোজ আপ এবং গাড়ি হিসেবে ফোর্ডের নাম রয়েছে। 

পণ্যের

উক্ত তালিকা সম্বলিত ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইসরায়েলি পণ্য দাবিতে বিভিন্ন ধরণের ৩৩ টি পণ্যের যে তালিকাটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে, সেগুলো ইসরায়েলি পণ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে এই পণ্যগুলোর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কোনোটির সাথে ইসরায়েলের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

পণ্যগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম প্রথমেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত পোস্টগুলো যাচাই করে। তবে পোস্টগুলোতে উক্ত পণ্যগুলোকে ইসরায়েলি পণ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও কোনো তথ্যসূত্র বা কিসের ভিত্তিতে এ পণ্যগুলোকে ইসরায়েলি পণ্য বলা হচ্ছে সে সম্পর্কিত কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি।

পরবর্তীতে দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে উক্ত পণ্যগুলোর প্রতিটির নাম ধরে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

বাটা

প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে অনুসন্ধানে এটির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, এটি ১৮৯৪ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের (তৎকালীন চেকোশ্লোভাকিয়া) জিলিন শহরে তিন সহোদরের হাত ধরে পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। 

বর্তমানে বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাটা কোম্পানির সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের লাউসেনে অবস্থিত।  প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমানে সন্দ্বীপ কাতারিয়া নামে একজন ভারতীয় নাগরিক কর্মরত আছেন। 

পাশাপাশি আরও দেখা যায়, বাটা বিশ্বের ৭০ টির বেশি দেশে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে ইসরায়েলে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ব্যবসা সম্পর্কে জানা যায় এটি প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩৪ বছর পর, ১৯২৭ সালে।  

শ্যাম্পু:  ক্লিয়ার, সানসিল্ক ও ডাভ
ওয়াশিং পাউডার:  সার্ফ এক্সেল, হুইল, রিন
ক্রিম/ বডি লোশন: ভ্যাসলিন, ডাভ, পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি
সাবান: লাক্স, ডাভ, লাইফবয়
বডি স্প্রে: এক্স
টুথপেস্ট: পেপসোডেন্ট, ক্লোজ আপ
এন্টি পারসপিরেন্ট: রেক্সোনা

এই পণ্যগুলো নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ক্লিয়ার, সানসিল্ক ও ডাভ এই তিনটি শ্যাম্পু ও ওয়াশিং পাউডার সার্ফ এক্সেল, হুইল, রিন এবং  ক্রিম বা বডি লোশনের মধ্যে ভ্যাসলিন, ডাভ, পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ইত্যাদি পণ্যগুলো ইউনিলিভার কোম্পানির। 

ইসরায়েলি পণ্য হিসেবে প্রচারিত তালিকাগুলোর মধ্যে থাকা টুথপেস্ট পেপসোডেন্ট নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটি একটি আমেরিকান ব্র্যান্ড। ১৯১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিকাগোর পেপসোডেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে এটি যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে ইউনিলিভার এটি কিনে নেয়। তবে ২০০৩ সালে ইউনিলিভার উত্তর আমেরিকায় পণ্যটির সত্ত্ব চার্চ অ্যান্ড ডোয়াইট নামে আরেকটি আমেরিকান কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়। 

আরেকটি টুথপেস্ট ক্লোজ আপ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটিও ইউনিলিভারের একটি পণ্য। 

এগুলো ছাড়াও এক্স বডি স্প্রেটিও ইউনিলিভারের তৈরি।

এন্টি পারসপিরেন্ট হিসেবে বহুল ব্যবহৃত রেক্সোনাও ইউনিলিভারের পণ্য। এটি ১৯০৮ সালে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় শেলডন ড্রাগ কোম্পানির হাতে তৈরি হয়। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে এটিও ইউনিলিভারের সাথে একীভূত হয়ে যায়।

পরবর্তীতে ইউনিলিভার সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যে ১৮৮৩ সালে লিভার সহোদরদের হাতে সানলাইট নামে একটি সাবান প্রস্তুত মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে।

এরপর  ১৯৩০ সালে নেদারল্যান্ডের কোম্পানি মার্গারিন ইউনির সাথে একীভূত হয়ে ইউনিলিভার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

বেবি লোশন: জনসন অ্যান্ড জনসন

পণ্যটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটি জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির একটি পণ্য। এই জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানি ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে। এর সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের নিউ ব্রান্সউইকে। 

নুডলস: ম্যাগী (Meggi)

পণ্যটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে Meggi হিসেবে প্রচার করা হলেও এটির শুদ্ধ বানান Maggi। এই নুডলসটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৮৪ সালে, সুইজারল্যান্ডের উদ্যোক্তা জুলিয়াস ম্যাগীর হাত ধরে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে নেসলে এটিকে কিনে নেয়। 

উল্লেখ্য, নেসলেও একটি সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি, যেটি ১৮৬৭ সালে হেনরি নেসলে নামক একজন জার্মান-সুইস নাগরিকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। 


কোল্ড ড্রিংকস বা কোমল পানীয়: কোকাকোলা, পেপসি, স্প্রাইট, ফান্টা, সেভেন আপ, অ্যাটম, অ্যাকুয়াফিনা

এই পণ্যগুলো নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, উল্লিখিত পণ্যগুলোর মধ্যে কোকাকোলা ১৮৮৬ সালে আমেরিকার আটলান্টার ফার্মাসিস্ট, জন এস. পেম্বারটন (১৮৩১-৮৮) তার পেম্বারটন কেমিক্যাল কোম্পানিতে তৈরি করেছিলেন।

পরবর্তীতে ১৮৯২ সালে কোকাকোলা কোম্পানী আমেরিকান কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর আমেরিকার আটলান্টার জর্জিয়ায় অবস্থিত। স্প্রাইট ও ফান্টা কোকাকোলারই দুইটি পণ্য।

অপরদিকে পেপসি, সেভেন আপ, অ্যাকুয়াফিনা, অ্যাটম নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই পণ্যগুলো পেপসিকো কোম্পানির তৈরি। পেপসিকো আমেরিকান ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি। এটি ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর নিউ ইয়র্কে। 

টয়লেট্রিজ: লরিয়াল,বস, গার্নিয়ার

এই পণ্যগুলোর মধ্যে লরিয়াল, গার্নিয়ার ফরাসি প্রসাধনী নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান লরিয়ালের পণ্য।

এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯০৯ সালে ইউজিন শ্যুলার নামে একজন ফরাসি ফার্মাসিস্ট এবং উদ্যোক্তার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। এটির সদর দফতরও ফ্রান্সে অবস্থিত।

অপরদিকে বস সম্পর্কে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটি ১৯২৪ সালে হুগো ফার্দিনান্দ বস নামে এক জার্মান নাগরিকের হাত ধরে মেটজিনজেন নামে জার্মানির একটি শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতরও এখানে অবস্থিত। 

চা: তাজা

এ চা নিয়ে অনুসন্ধানে তাজা নামের আলাদা কোনো পণ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং অনুসন্ধানে Brooke Bond Taaza Tea নামে একটি চা পাতার ব্র্যান্ড খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রুক বন্ড ১৮৪৫ সালে আর্থার ব্রুক নামে একজন ব্রিটিশের হাত ধরে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি লিপটন টিস অ্যান্ড ইনফিউশন্স এবং ইউনিলিভারের সাথে একীভূত হয়ে যায়।

পাউডার: পন্ডস

এই পাউডারটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৮৪৬ সালে আমেরিকান ফার্মাসিস্ট থেরন টি পন্ড টি টি পন্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই পন্ডসের যাত্রা। বর্তমানে এটিও ইউনিলিভারের সাথে একীভূত হয়ে গিয়েছে। 

গাড়ি: ফোর্ড

এই গাড়ি কোম্পানিটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটিও একটি আমেরিকান কোম্পানি১৯০৩ হেনরি ফোর্ড ও ১১ জন বিনিয়োগকারীর হাত ধরে এটি যাত্রা শুরু  করে। এর সদর দফতর মিশিগানের ডেট্রয়েটে অবস্থিত। 

এই পর্যন্ত অনুসন্ধানে উক্ত পণ্যগুলোর কোনোটিরই উৎপাদন, প্রতিষ্ঠা বা কারখানার সাথে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

মূলত, গত ০৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে হামলা শুরু করে। এই হামলার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলও হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকায় পাল্টা হামলা চালায়। এতে দেশ দুইটির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাত নতুন মাত্রা পায়৷ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের পণ্য বয়কট করার আহবান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু পণ্যের একটি তালিকা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই তালিকা থাকা পণ্যগুলোর কোনোটিই ইসরায়েলের পণ্য নয়। বরং কোনো ধরনের নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানের পণ্যের নাম যুক্ত করে উক্ত তালিকাটি তৈরির মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। 

সুতরাং, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলি পণ্য হিসেবে কতিপয় পণ্যের নামের একটি তালিকা প্রচার করা হচ্ছে; যা মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img