সম্প্রতি, তানজানিয়ার ন্যাট্রন হ্রদে কোনো জীবন্ত প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যায় শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমনকিছু পোস্ট দেখুন এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে(আর্কাইভ)
এছাড়াও, জাতীয় গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে একই দাবিতে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন সময় টিভি, যুগান্তর, যায়যায়দিন, কালেরকণ্ঠ, এনটিভি নিউজ
একই দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন ওয়ান ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিন
ফ্যাক্টচেক
তানজানিয়ার ন্যাট্রন হ্রদে কোনো জীবন্ত প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয় বরং ন্যাট্রন হ্রদে নীলাভ-সবুজ শৈবাল, তেলাপিয়া মাছ, ফ্লেমিঙ্গো পাখিসহ বেশকিছু প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে।
ন্যাট্রন লেক
ন্যাট্রন লেক উত্তর তানজানিয়ার কেনিয়া সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত একটি লবণাক্ত পানির হ্রদ। ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত এ হ্রদটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির পাদদেশে অবস্থিত। হ্রদের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। এ হ্রদের পানির pH মান ১২’র অধিক। অর্থাৎ, হ্রদটি একটি উষ্ণ তাপমাত্রার অতি ক্ষারীয় লবণের হ্রদ। হ্রদের পানিতে অতি লবণাক্ত পরিবেশ সহিষ্ণু একধরনের ব্যাকটেরিয়া বাস করে যার রঙের কারণে হ্রদের পানিকে লাল দেখায়।
প্রচারিত ছবিগুলোর উৎস কী?
প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, Huffpost এর ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর “Deadly Lake Natron Turns Animals Into Ghostly ‘Statues’ (PHOTOS)” শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইন্টারনেটে প্রচারিত ছবিগুলো ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তানজানিয়ার ন্যাট্রন লেক থেকে নিক ব্রান্ডট নামের ফটোগ্রাফার ধারণ করেছিলেন।
ফটোগ্রাফার ব্যান্ডট জানান, সমুদ্রতীরে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই তিনি মৃত প্রাণীদেহগুলোর খোঁজ পান। তিনি খেয়াল করেন মৃত প্রাণীগুলো মৃত্যুর পরেও জীবিত প্রাণীর অবয়বের মতোই আছে। এছাড়াও খুঁজে পাওয়া প্রাণীর মৃতদেহগুলো পাথরের মত শক্ত বলেও বর্ণনা করেন তিনি।
নিক ব্র্যান্ডট এর তোলা বিভিন্ন প্রাণীর মরদেহের ধূসর বর্ণের ছবি পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ‘অ্যাক্রস দি র্যাভেজড ল্যান্ড’ বইয়ে প্রকাশিত হয়। এই ছবিগুলোই আলোচিত দাবিতে প্রচারিত হয়ে আসছে।
কেন এমনটি ঘটে?
প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, NBC News এর ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর “The bird mummies of Natron: Lake’s waters petrify animals that fall in” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছোট ছোট পাখি ও বাদুড়ের কিছু প্রজাতি যারা দীর্ঘ এই হ্রদটি পাড়ি দিতে পারে না তারা প্রায়শই হ্রদের পানিতে পড়ে যায়। হ্রদের পানির বাষ্পীভবনের হার অনেক বেশি হওয়ার হ্রদের পানির উচ্চতা কমবেশি হতে থাকে। উচ্চতা কমে গেলে পানিতে পড়ে যাওয়া প্রাণীর মৃতদেহগুলো তীরে ভেসে আসে এবং মৃতদেহ লবণের আস্তরণে ঢাকা থাকে।
উক্ত প্রতিবেদনে ইউনিভার্সিটি অব লিচেস্টারের বাস্তুতন্ত্রবিদ ডেভিড হারপারের বরাত দিয়ে জানানো হয়, সাধারণত মরদেহ অন্য কোথাও পড়ে থাকলে দ্রুত পঁচে যায়। কিন্তু এখানে(ন্যাট্রন লেক) মৃত প্রাণীদেহগুলোতে লবণের আস্তরণ পড়ে এবং এটা এভাবেই থেকে যায়।
এছাড়াও, প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, Exploring Africa এর ওয়েবসাইটে “LAKE NATRON” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ন্যাট্রন হ্রদের পানি অত্যধিক লবণাক্ত। এসব লবণের মধ্যে সোডিয়াম ও কার্বোনেট লবণ অন্যতম। হ্রদের পানিতে হাইড্রেটেড সোডিয়াম কার্বনেট বা ন্যাট্রন যৌগের উপস্থিতি রয়েছে।
ন্যাট্রন হলো একটি অতি ক্ষারীয় লবণ। যদি কোনো মৃতদেহের ওপর ন্যাট্রনের প্রলেপ লাগানো হয়, তবে এই লবণ প্রাণীদেহের সমস্ত পানি শুষে নেয়। এছাড়াও, মৃতদেহের পঁচনশীলতার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াসমূহ ন্যাট্রনের অতি ক্ষারীয় প্রভাবে টিকে থাকতে পারে না। এভাবে ন্যাট্রনের উপস্থিতি মৃতদেহকে পঁচনশীলতা থেকে বাঁচায়।
অর্থাৎ, হ্রদের পানিতে ন্যাট্রন যৌগের উপস্থিতির কারণেই মৃতপ্রাণীদেহগুলো পঁচে না গিয়ে জীবিত প্রাণির অবয়বের ন্যায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়।
ন্যাট্রন লেক কি সকল প্রাণীর জন্য মরণঘাতি?
Medium এর তথ্য অনুসারে, বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও ন্যাট্রন হ্রদ বেশকিছু প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থল। ফ্লেমিঙ্গো পাখির জন্য ন্যাট্রন হ্রদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন প্রজনন ক্ষেত্র। এছাড়াও, হ্রদের পানিতে উচ্চ তাপমাত্রা ও ক্ষার সহিষ্ণু তেলাপিয়া মাছ ও বেশকিছু নীলাভ সবুজ শৈবাল দেখা যায়। অত্যন্ত বৈরী আবহাওয়ার ন্যাট্রন হ্রদের পানিতে বসবাসের জন্য বছরের পর বছর ধরে এসব প্রজাতি নিজেদের অভিযোজিত করেছে।
মূলত, ন্যাট্রন হৃদের বৈরী আবহওয়ার প্রতি সকল প্রাণীর অভিযোজন ক্ষমতা না থাকার কারণেই হ্রদের পানিতে পড়ে যাওয়া প্রাণীদের মৃত্যু ঘটে এবং দেহের ওপর হ্রদের পানিতে থাকা অতি ক্ষারীয় লবণের আস্তরণ পড়ে। ন্যাট্রন নামের লবণের এই আস্তরণ মৃতদেহগুলোর পঁচন রোধ করে ও মৃতদেহগুলোকে পাথরের মতো শক্ত করে তোলে। এ ঘটনাকেই বিগত কয়েক বছর ধরে তানজানিয়ার ন্যাট্রন হ্রদে কোনো জীবন্ত প্রাণী পড়লেই পাথর হয়ে যায় দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অতি বৈরী আবহাওয়ার এই হ্রদেও তেলাপিয়া মাছ ও ফ্লেমিঙ্গো পাখিসহ বেশকিছু প্রজাতির প্রাণী দেখা যায়।
সুতরাং, তানজানিয়ার ন্যাট্রন হ্রদে কোনো জীবন্ত প্রাণী পড়লেই মরে পাথর হয়ে যাওয়ার তথ্যটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Tanzania Specialist: Lake Natron
- Huffpost: “Deadly Lake Natron Turns Animals Into Ghostly ‘Statues’ (PHOTOS)”
- Nick Brandt: Website
- NBC News: “The bird mummies of Natron: Lake’s waters petrify animals that fall in”
- Exploring Africa: “LAKE NATRON”
- Medium: “# Unveiling the Mystique of Lake Natron: A Glimpse into a Natural Wonder”