বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন দিয়েছে শীর্ষক দাবিতে বানোয়াট ভিডিও প্রচার

সম্প্রতি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন দিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ক্ষিপ্ত আ’লীগ’ শীর্ষক শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশনে সেনাবাহিনীর স্মারকলিপি দেওয়ার দাবিতে একটি ভিডিও ইউটিউব ও টিকটকে প্রচার করা হচ্ছে।

Screenshot: YouTube

ইউটিউবে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে। 

Screenshot Source: YouTube

টিকটকে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে। 

Screenshot Source: TikTok

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন কিংবা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে কোনো স্বারকলিপি দেয়নি বরং ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কয়েকটি ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় একটি ভিডিওটি তৈরি করে কোনোপ্রকার তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। 

গত ৪ এপ্রিল Sabai Sikhi(আর্কাইভ) নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে এবং sifat…12345(আর্কাইভ) নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে ১ মিনিট ৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়।

Screenshot Source: Image Collage by Rumor Scanner

অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। সেখানে দেখা যায়, এটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কয়েকটি ছবি ও ভিডিও ক্লিপ নিয়ে তৈরি একটি নিউজ ভিডিও। সেখানে সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তাকে দেখা যায়। 

১ মিনিট ৪ সেকেন্ডের এই নিউজ ভিডিওটিতে বলা হয়, ‘এবার সরকারের অনুমোদন দিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নেওয়ার ব্যবস্থার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিকট একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুকূলে সকল রাজনৈতিক দল যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের যোগ্যতা যাচাই করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এছাড়া জনগণ যেন নির্ভিগ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেদিকে তদারকি করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এদিকে নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ইভিএম এর পরিবর্তে তিনশো আসনে ব্যালটের মাধ্যমে তাদের প্রার্থী নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যাতে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে সঠিকভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারে। এদিকে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেওয়ায় বিপাকে পড়ে গেলো আওয়ামী লীগ সরকার।’

উক্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক একাধিক কি ওয়ার্ড সার্চ করেও উক্ত দাবিগুলোর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কয়েকটি আলাদা ছবি এবং ভিডিও যুক্ত করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই দাবিগুলো প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়া ভিডিও’র শুরুতে যাকে একটি ফাইলে স্বাক্ষর করতে দেখা যাচ্ছে তিনি বর্তমানে সেনাবাহিনীর কোনো দায়িত্বে নেই বরং তিনি সাবেক সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক। তিনি ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেনাপ্রধানেরদায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর বর্তমান প্রধান হলেন এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

পাশাপাশি ভিডিওটির কি ফ্রেম কেটে কয়েকটি স্থিরচিত্র নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায় সেগুলো অনেক পুরোনো প্রতিবেদন থেকে নেওয়া ছবি। ভিডিওটির ১৭ সেকেন্ডের সময় সেনাবাহিনীর এক উর্ধতন কর্মকর্তাকে মিডিয়ার সামনে কথা বলতে দেখা যায়। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, উক্ত ছবিটি জাগো নিউজ এর অনলাইন সংস্করণে ২০২২ সালের ০৫ জুন ‘যতক্ষণ আগুন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেনাবাহিনী থাকবে’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন(আর্কাইভ) থেকে নেওয়া হয়েছে।

Image Comparison by Rumor Scanner

এছাড়াও ভিডিওটির ২৪ সেকেন্ডের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩ সদস্যকে রাস্তায় টহল দিতে দেখা যায়। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, উক্ত ছবিটি বিবিসি নিউজের অনলাইন সংস্করণে  ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ‘নির্বাচনী কাজে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন(আর্কাইভ) থেকে নেওয়া হয়েছে।

Image Comparison by Rumor Scanner

অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার কয়েকটি আলাদা ছবি এবং ভিডিও জুড়ে দিয়ে আলোচিত ভিডিওটি ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে। 

এছাড়া মূলধারার গণমাধ্যম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট, নির্বাচন কমিশনের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট কিংবা অন্যকোনো সূত্রে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন কিংবা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিকট কোনো স্মারকলিপি দেওয়ার কোনো সংবাদ সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের পদ্ধতি কি?

বাংলাদেশের সংবিধান ৮০ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের পদ্ধতি নিম্নরুপ:

(১) আইনপ্রণয়নের উদ্দেশ্যে সংসদে আনীত প্রত্যেকটি প্রস্তাব বিল আকারে উত্থাপিত হইবে।

(২) সংসদ কর্তৃক কোন বিল গৃহীত হইলে সম্মতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিতে হইবে।

(৩) রাষ্ট্রপতির নিকট কোন বিল পেশ করিবার পর পনর দিনের মধ্যে তিনি তাহাতে সম্মতিদান করিবেন কিংবা অর্থবিল ব্যতীত অন্য কোন বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তাহার কোন বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার কিংবা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্দেশিত কোন সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জ্ঞাপন করিয়া একটি বার্তাসহ তিনি বিলটি সংসদে ফেরত দিতে পারিবেন; এবং রাষ্ট্রপতি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।]

(৪) রাষ্ট্রপতি যদি বিলটি অনুরূপভাবে সংসদে ফেরত পাঠান, তাহা হইলে সংসদ রাষ্টপতির বার্তাসহ তাহা পুনর্বিবেচনা করিবেন; এবং সংশোধনীসহ বা সংশোধনী ব্যতিরেকে ২[***] সংসদ পুনরায় বিলটি গ্রহণ করিলে সম্মতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে এবং অনুরূপ উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন; এবং রাষ্ট্রপতি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

(৫) সংসদ কর্তৃক গৃহীত বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করিলে বা তিনি সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইলে তাহা আইনে পরিণত হইবে এবং সংসদের আইন বলিয়া অভিহিত হইবে।

Screenshot: bdlaws.minlaw.gov.bd

অর্থাৎ, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়নের একমাত্র ক্ষমতা বাংলাদেশের আইনসভা জাতীয় সংসদের। কোনো আইন অনুমোদনের ক্ষমতা সংসদ ব্যতীত সেনাবাহিনী কিংবা অন্য কোনো সংস্থার নেই।

মূলত, সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নেওয়ার ব্যবস্থার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিকট একটি স্মারকলিপি দিয়েছে দাবি করে একটি ভিডিও ইউটিউব এবং টিকটকে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন কিংবা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে কোনো স্বারকলিপি দেয়নি।

উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাম জড়িয়ে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে পূর্বেও একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। 

সুতরাং, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিল অনুমোদন এবং এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দেওয়ার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img