জাতিসংঘের লোগো ব্যবহার করে সংস্থাটির প্রতিবেদনের তথ্য দাবিতে জুলাই আন্দোলন নিয়ে ভুয়া তথ্য প্রচার

গত ১২ জানুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে ঘটা মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি, জাতিসংঘের লোগোযুক্ত একটি ইনফোগ্রাফিক্স সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে, আন্দোলনের সময়জুড়ে দেশে ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যারা মূলত অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে ৭ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে মারা যান। যার সংখ্যা ৭৫০। এছাড়াও দাবি করা হয়, আন্দোলনের মুহূর্তে মাত্র ৪০০ জন মারা গিয়েছেন এবং ৫ আগস্ট থেকে ৬ আগস্টের মধ্যে ২৫০ জন মারা গিয়েছেন। যাদের মধ্যেও আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত পোস্টটির শিরোনামে বলা হয়, “এটি বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে মৃত্যুর সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান! যদি আগস্ট ৫-এর আগে নিহতদের জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী হয়, তবে আগস্ট ৫-এর পর নিহতদের জন্য দায়ী কে? এই সহজ প্রশ্নের উত্তর মানবাধিকার কমিশনের দেওয়া উচিত।”

ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলন ও পরবর্তীতে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রকাশিত ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনের ইনফোগ্রাফিক্সের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি ভুয়া। বরং ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে এ ধরনের কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। প্রতিবদনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ১৪০০ জনের মৃত্যুর তথ্য আছে। তাছাড়া, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৪৪ জন সদস্য নিহত হয়েছেন বলে দলটির পক্ষ থেকে ওএইচসিএইচআরকে জানানো হলেও এসব তথ্য জাতিসংঘের সহযোগী এই সংস্থা স্বাধীনভাবে যাচাই করেনি।

দাবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জুলাই আন্দোলন দমনে ‘সমন্বয়ের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী’: জাতিসংঘ রিপোর্ট শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গত জুলাই-অগাস্টে প্রায় ১৪০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 

এছাড়াও প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায় ওএইচসিএইচআর-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেসময় আরও হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ও র‍্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৭০০ জনকে তখন আটক করা হয়েছিলো। পাশাপাশি জানা যায়, নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ-ই ছিল শিশু। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে ও পঙ্গু হয়েছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।

পরবর্তীতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর)-এর ওয়েবসাইট Human Rights Violations and Abuses related to the Protests of July and August 2024 in Bangladesh শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত মূল ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখে রিউমর স্ক্যানার। দেখা যায়, প্রতিবেদনটির ৫৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর তথ্যমতে (পুরনাবৃত্তি পরিহার করে) অন্তত ১৩ জন মহিলাসহ ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তবে মোট নিহতের সংখ্যা ব্যতীত উক্ত প্রতিবেদনে বাকি দাবিগুলোর উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও প্রতিবেদনে ‘আন্দোলনকারী’ (Rioters), ‘আওয়ামী লীগ সমর্থক’ (AL Supporters), বা ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য’ (Law Enforcement Personnels) এমন সুনির্দিষ্ট ভুক্তভুগীর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

Screenshot: OHCHR 

পাশাপাশি প্রতিবেদনটির ২১১ নম্বর অনুচ্ছেদে অভ্যুত্থানের পরবর্তীতে সময়ে অর্থাৎ, ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত একাধিক প্রতিশোধমূলক সহিংসতার তথ্য পাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।

Screenshot: OHCHR 

প্রতিবেদনটির ২২২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওএইচসিএইচআরকে ১৪৪ জন নিহত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের তালিকা প্রদান করা হয়। যেখানে তাদের নাম, মৃত্যুর তারিখ এবং কারণ বিস্তারিতভাবে দেওয়া হয়েছে। তবে উক্ত তথ্যসমূহ ওএইচসিএইচআর-এর পক্ষে যাচাই করা হয়নি বলেও অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়।

Screenshot: OHCHR 

এছাড়াও ২২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যের বরাতে বলা হয়, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৪ জন পুলিশ নিহত হয়েছে। পাশাপাশি ৩ জন বিজিবি সদস্য, ৩ জন আনসার/ভিডিপি সদস্য এবং ২ জন র‌্যাব সদস্য নিহত হওয়ার তথ্য অনুচ্ছেদটিতে পাওয়া যায়।

Screenshot: OHCHR 

অর্থাৎ, ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় জাতিসংঘের লোগো ব্যবহার করে একটি ভুয়া তালিকা তৈরি করে আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছে।

সুতরাং, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই আন্দোলনে ৪০০ জন মারা গিয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img