ঢাবির প্রো-ভিসির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের দেওয়া স্লোগানকে ইউনূস বিরোধী স্লোগান দাবিতে প্রচার

অন্তত গতকাল (২৬ জানুয়ারি) থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিক্ষোভ ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “সাইন্সল্যাব মোড়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছে- “ইউনূস তুই স্বৈরাচার, এই মূহুর্তে গদি ছাড়”।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে, (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

উক্ত দাবিতে এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত উক্ত পোস্টটি ৩ লক্ষেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং ২০ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টটিতে লাইক দেওয়া হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বৈরাচার দাবি করে পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভের দৃশ্যের নয় বরং, অশোভন আচরণ করে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে ঢাবি প্রো-ভিসির (শিক্ষা) ক্ষমা চাওয়া ও শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি মেনে নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভের ভিডিওকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে তাতে প্রচারিত দাবিটির সপক্ষে একটি ভিডিও এর সংযুক্তি ব্যতীত কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ করতে দেখা যায়নি৷ তাছাড়া, প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে ‘প্রো-ভিসি তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়’ স্লোগানসহ নানা স্লোগান শুনতে পাওয়া গেলেও দাবিকৃত ‘ইউনূস তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়’ শীর্ষক স্লোগানটি শোনা যায়নি।

পরবর্তী অনুসন্ধানে ‘সিউবি ইনসাইডার্স – সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ’ নামের একটি ফেসবুক পেজে উক্ত ঘটনার একটি ভিডিওসহ গতকাল (২৬ জানুয়ারি) প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়৷ উক্ত ভিডিওটির সাথে প্রচারিত ভিডিওটির পারিপার্শ্বিক দৃশ্য ও ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। পোস্টটির ক্যাপশনে বলা হয়, “প্রো-ভিসি তুই স্বৈরাচার এই মুহূর্তে গদি ছাড়”। স্লোগানে উত্তাল নীলক্ষেত-নিউমার্কেট”।

Comparison : Rumor Scanner

একই ফেসবুক পেজে গতকাল (২৬ জানুয়ারি) পোস্টকৃত আরেকটি পোস্টে বলা হয়, “আজ ঢাবি প্র ভিসি আমাদের যে ভাবে অপমান করছে তা মানার মতো না, সবাই নীতক্ষেত মোড়ে চলে আসেন। ৭ কলেজের যে যেখানে আসেন নীলক্ষেত মোড়ে চলে আসেন।আজ এখন থেকে রাস্তা ব্লোক শুরু। নীতক্ষেত ব্লোক করা হবে আজ। ৭ কলেজে ভর্তির আসন কমানো সহ ৫ দফা দাবি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ঢাবির প্রো-ভিসি শিক্ষা  এবং কয়েকজন শিক্ষক সাত কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে অপমান করে বের করে দেয় ! শিক্ষার্থীদের নিকট ক্ষমা চাওয়া সহ সবগুলো দাবি রাতের মধ্যে মেনে নিতে হবে ! 

সমাধানের আগ পর্যন্ত নীলক্ষেত সাইন্সল্যাব বন্ধ!”

এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে ঢাকা কলেজ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের ফেসবুক পেজে বিক্ষোভের একটি ভিডিওসহ একটি পোস্ট পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়, “৫ দফা দাবিতে রাজধানীর মিরপুর সড়ক অবরোধ করেছে ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।” 

এছাড়া, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ সাংবাদিক সমিতির ফেসবুক পেজে গতকাল (২৬ জানুয়ারি) প্রচারিত একটি ভিডিও পোস্টে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের একজন শিক্ষার্থী বিক্ষোভের কারণ জানান। তিনি জানান, গত ৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসিসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন। মাঝে তারা আন্দোলন থেকে সরে গিয়েছিলেন। তবে এখন দাবি হচ্ছে, নতুন কাঠামোতে যেন তাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। সেক্ষেত্রে প্রথম দাবি ছিল, সীট সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়াও আরো কয়েকটি দাবির বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন৷ তবে কোথাও ড. ইউনূসের পদত্যাগ বা ইউনূসকে স্বৈরাচার বলার বিষয়ে কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে গতকাল (২৬ জানুয়ারি) “সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা, সড়কে যানজট” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়৷ উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “পাঁচ দফা দাবিতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। আজ রোববার (২৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তাঁরা ঢাকা কলেজের সামনে জড়ো হন। এরপর সেখানে কিছু সময় থেকে সরে এসে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে অবস্থান নেন। এতে সায়েন্স ল্যাব, নীলক্ষেত মোড়, এলিফ্যান্ট রোডসহ আশপাশে সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ সাত কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে অপমান করেন। এর প্রতিবাদে তাঁরা সড়ক অবরোধ করেছেন। তাঁরা জানান, তাঁদের পাঁচ দফা দাবি মেনে নিতে হবে এবং সহ–উপাচার্যকে তাঁর আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। […]

তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ তারা এসেছিল আমার সঙ্গে কথা বলতে। তখন আমি তাদের বলি, তোমরা সবাই না এসে দুজন আসো। কিন্তু অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে ঢুকে যায়। ঘটনা এতটুকুই। সেখানে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করা হয়নি।’ তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা বিষয়ে আগামীকাল সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টায় সাত কলেজের বিষয়ে যে কমিটি আছে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। […] শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবিগুলো হলো ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে, শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা, ভর্তি পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটতে হবে ও সাত কলেজের ভর্তি ফির স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি জমা রাখতে হবে।”

এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম ঢাকা পোস্টের ওয়েবসাইটে গতকাল (২৬ জানুয়ারি) প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়৷ এছাড়াও উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “এসময় অবরোধ করা শিক্ষার্থীদের ‘প্রো-ভিসি তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়’, ‘আমাদের পাঁচ দফা, মানতে হবে মানতে হবে’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘আমাদের সংগ্রাম, চলছেই চলবে’, ‘এই মুহূর্তে ক্ষমা চাইবি, পাঁচ দফা মেনে নিবি’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে।” অর্থাৎ, সংবাদমাধ্যম থেকেও জানা যায় স্লোগানে প্রো-ভিসি’কে উল্লেখ করে স্বৈরাচার ডাকা হয় এবং পদত্যাগ করতে বলা হয়। এ বিষয়ে ড. ইউনূসের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। 

সুতরাং, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দেওয়া ঢাবির প্রো ভিসি বিরোধী স্লোগানকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের স্লোগান দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

হালনাগাদ/ Update

৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ : এই প্রতিবেদন প্রকাশ পরবর্তী সময়ে একই দাবি টিকটক পোস্ট আমাদের নজরে আসার প্রেক্ষিতে উক্ত পোস্টটি প্রতিবেদনে দাবি হিসেবে যুক্ত করা হলো।

আরও পড়ুন

spot_img