শেখ মুজিবুর রহমানের আসল নাম দেবদাস চক্রবর্তী নয়

শেখ মুজিবুর রহমানের আসল নাম ও তার জন্ম পরিচয় সংক্রান্ত একটি বিষয় সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটে ছড়ানো সেই পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে যে, ‘জন্মের সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল দেবদাস চক্রবর্তী এবং তার মায়ের নাম ছিল গৌরিবালা দাস।’

দাবিটির সারসংক্ষেপ হলো: “মিঃ চন্ডিদাস, কলকাতা সিভিল কোর্টের উকিল, তার মেয়ে গৌরিবালা দাসের সাথে তার সহকারী উকিল মিঃ অরন্য কুমার চক্রবর্তীর অবৈধ সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে গৌরিবালা গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং অরন্য কুমার চক্রবর্তীর কাছে বিয়ের দাবি জানান, কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। চন্ডিদাস বিষয়টি জানার পর গৌরিবালাকে অবিলম্বে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেন, কিন্তু অরন্য কুমার রাজি হন না। গৌরিবালার পুত্র দেবদাস চক্রবর্তীর বয়স যখন তিন বছর, চন্ডিদাসের মহুরী শেখ লুৎফর রহমান গৌরিবালাকে বিয়ে করেন এবং এফিডেভিটের মাধ্যমে গৌরিবালার নাম ছাহেরা বেগম এবং পুত্রের নাম দেবদাস চক্রবর্তীর পরিবর্তে শেখ মজিবুর রহমান রাখা হয়। এফিডেভিট নং- ১১৮, তারিখ- ১০/১১/১৯২৩ ইং সাল, কলকাতা সিভিল কোর্ট, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। সাক্ষী হিসেবে উল্লিখিত ছিলেন জনাব আব্দুর রহমান সাফায়াত ও শ্রী অনিল কুমার।”

দেবদাস

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ) । 

উক্ত দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

উক্ত দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ) ।

উক্ত দাবিতে টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রচারিত দেবদাস চক্রবর্তী সংক্রান্ত গল্পটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। দেবদাস চক্রবর্তী এবং গৌরিবালা দাস সংক্রান্ত দাবির কোনোপ্রকার ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, প্রচারিত গল্প অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পিতামাতার প্রথম সন্তান দাবি করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান।  প্রচারিত গল্পে ১৯২৩ সালে কলকাতা সিভিল কোর্টের একটি এফিডেভিটের কথা উল্লেখ করা হলেও, বাস্তবে কলকাতা সিটি সিভিল কোর্ট প্রতিষ্ঠিতই হয় ১৯৫৭ সালে। এছাড়াও, অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ আরো অন্যান্য বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে এবং প্রতিষ্ঠিত তথ্য অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলোর সাথে ওই গল্পের কোনো মিল নেই। প্রতিষ্ঠিত তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নানার নাম ছিল আব্দুল মজিদ।

দাবির প্রমাণ হিসেবে ছড়িয়েছে দুইটি প্রচারপত্র, সংসদ সদস্যের বক্তব্য ও ইসলামি বক্তার বক্তব্য

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, এই দাবির প্রচারে প্রমাণ বা রেফারেন্স হিসেবে দুইটি প্রচারপত্র, একজন সংসদ সদস্যের সংসদে দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও এবং প্রয়াত ইসলামি বক্তা আব্দুল হালিম বুখারীর একটি বক্তব্যের অডিও ছড়ানো হয়েছে। এজন্য শুরুতেই এই সকল রেফারেন্সগুলো যাচাই করেছি আমরা।

প্রচারপত্রগুলোর বিশ্লেষণ

প্রথম প্রচারপত্রটির অস্তিত্ব অন্তত ২০১০ সাল থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে। সামহোয়্যার ইন ব্লগে ২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি পোস্টে এটি পাওয়া যায়। ‘আবিদ হাসান’ নামের ব্যবহারকারী দাবি করেন, প্রচারপত্রটি তিনি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। একই দাবির দ্বিতীয় আরেকটি প্রচারপত্রও প্রচার হতে দেখা যায়।

প্রচারপত্র দুটি বিশ্লেষণ করে সেগুলোতে উল্লিখিত দাবির মধ্যে অসংখ্য অসংগতি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, প্রথম প্রচারপত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের মায়ের নাম গৌরিবালা দাস থেকে পরিবর্তন করে ছালেহা বেগম রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ থাকলেও অপরদিকে দ্বিতীয়টিতে শেখ মুজিবুর রহমানের মায়ের নাম গৌরিবালা দাস থেকে পরিবর্তন করে ছাহেরা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত, শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে তাঁর মায়ের নাম সায়েরা খাতুন হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, যা নির্ভরযোগ্য অন্যান্য উৎসেও সমর্থিত। এছাড়া, প্রথম প্রচারপত্রে শেখ লুৎফর রহমানকে দেবদাসের মুহুরী (সহকারী বা সহায়ক ব্যক্তি) হিসেবে দাবি করা হয়েছে, যেখানে দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, তিনি চন্ডিদাসের মুহুরী ছিলেন। যেখানে, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার

সিভিল কোর্ট ও এফিডেভিটের বিশ্লেষণ

প্রচারিত দাবিতে ১৯২৩ সালের ১০ নভেম্বর কলকাতা সিভিল কোর্টের এফিডেভিট নং ১১৮ এর উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কলকাতার প্রথম সিটি সিভিল কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। কোর্ট প্রতিষ্ঠার ৩৪ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯২৩ সালে এমন কোনো এফিডেভিটের অস্তিত্ব থাকা সম্ভবই নয়।

এছাড়াও, যে ডকুমেন্টটি এফিডেভিট হিসেবে দাবি করা হচ্ছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে কোনো বৈধ আদালতের নথি নয়; এটি একটি টাইপকৃত ও প্রিন্টেড ডকুমেন্ট যেখানে ‘বাংলাদেশ’ সহ আরও অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা ঐ সময়ে (১৯২৩ সালে) প্রচলিত ছিল না। তখন ব্রিটিশ ভারতের আওতাধীন অঞ্চল ছিল বাংলা, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

শুধু তাই নয়, কথিত এই এফিডেভিট কোনো সাক্ষীর সই বা আদালতের কোনো বৈধ সিলও নেই, যা সাধারণত আইনি ডকুমেন্টের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। বৈধ আদালতের নথির ক্ষেত্রে স্বাক্ষর ও সিলের অনুপস্থিতি এটিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা প্রচারণা হিসেবে প্রমাণ করে।

শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক পরিচয়

প্রচারপত্রের দাবি অনুযায়ী, শেখ মুজিবকে তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের প্রথম সন্তান হিসেবে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, শেখ মুজিব ছিলেন তার পিতামাতার ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম এবং মেজ বোনের নাম আছিয়া বেগম। এছাড়াও সেজ বোন হেলেন, ছোট বোন লাইলী এবং ছোট ভাই শেখ আবু নাসের।

শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ও প্রতিষ্ঠিত তথ্য (,) অনুযায়ী, শেখ আবদুল হামিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাদা। শেখ আবদুল হামিদের অকালমৃত্যু এবং বড় ছেলের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ছোট ছেলে শেখ লুত্ফর রহমানের ওপর। সে সময় তিনি এন্ট্রান্স শ্রেণিতে পড়াশোনা করলেও পারিবারিক প্রয়োজনে লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ানি আদালতে চাকরি নেন। শেখ লুত্ফর রহমানের সঙ্গে তার চাচা শেখ আবদুল মজিদের ছোট মেয়ের বিয়ে হয় এবং এই দম্পতির ঘরেই শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।

সংসদে আলোচিত বক্তব্য

আলোচিত এই দাবিতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা সংসদে দেওয়া বক্তব্যটি মূলত বিএনপির তৎকালীন সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানুর। দেবদাস চক্রবর্তী সংক্রান্ত এই গল্পটি প্রচারের সময় জোড়ালোভাবে একটি দাবি করা হচ্ছিল যে, সংসদে এই বক্তব্যের সময় সবাই কেন চুপ ছিল কিংবা কেন কোনো প্রতিবাদ করেনি।


Screenshot: Facebook

তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৩ সালে এই বক্তব্যটি প্রদানকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ছয়বার মাইক বন্ধ করে দেন এবং এই বক্তব্যকে বিধিবহির্ভূত বলে ঘোষণা করেন।

সেসময়ে এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জুনায়েদ আহমেদ পলক সংসদে অসংসদীয় ও অশালীন বক্তব্য প্রদানের দায়ে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের বেতন থেকে ৩০ হাজার টাকা কেটে নেওয়া দাবি জানান। এছাড়া, ওই বক্তব্যের পরপরই সরকার দলের সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি পালটা বক্তব্য দেন।

সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানুর বক্তব্যের এই ভিডিওটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি একটি কাগজ দেখে এমন বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তার এই বক্তব্যের সাথে উল্লিখিত প্রথম প্রচারপত্রটির লেখারও হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, রেহানা আক্তার রানু প্রথম প্রচারপত্রের লেখাটি দেখেই বক্তব্য দিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

মুফতি আব্দুল হালিম বুখারীর বক্তব্য

প্রয়াত ইসলামি বক্তা মুফতি আব্দুল হালিম বোখারী ১৯৯৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম সম্পর্কে আলোচিত দাবিটি উত্থাপন করেছেন দাবি করে একটি অডিও ক্লিপও প্রচার করা হচ্ছে।

অডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, তিনি সেখানে চার দলীয় জোটের ক্ষমতায় আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেন এবং এর ফলে পুলিশ সদস্যদের আচরণে পরিবর্তন এসেছে বলে মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য, চার দলীয় জোট ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। যদিও তার বক্তব্যের কিছু অংশ থেকে ওই সময়ের দিকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তবে অডিওর বক্তব্য শুনে নির্দিষ্টভাবে সময়কাল নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে, অডিওতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম পরিচয় সংক্রান্ত একটি কাগজের লেখা পাঠ করেছিলেন, যা দন্ত্য স বা ‘স’ নামে পরিচয় দেওয়া একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লেখা। মুফতি আব্দুল হালিম মূলত সেই লেখাটি পড়ে শোনান এবং শেষে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহও প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থাৎ, মুফতি আব্দুল হালিম নিজে এই বিতর্কিত দাবি করেননি বরং অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লেখা তুলে ধরে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি।

মূলত, এই দাবির সত্যতা নিয়ে কোনোপ্রকার বিশ্বস্ত উৎস বা নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক নথি পাওয়া যায়নি। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও তাঁর জীবনীমূলক বইয়ে তার মা-বাবার নাম, তার বংশপরিচয়, এবং তার জীবনের নানা দিক বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, কিন্তু এমন কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা এই ধরনের বিতর্কিত দাবির সমর্থন করে।

সুতরাং, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম পরিচয় নিয়ে ও তাকে দেবদাস চক্রবর্তী দাবি করে কয়েক যুগ ধরে প্রচার করে আসা এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img