গত ২৯ আগস্ট রাতে বিজয়নগরে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে দুই পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলপ্রয়োগ করে। এ সময় লাঠিচার্জের ঘটনায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানসহ অনেকেই আহত হন। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি একজন ব্যক্তির ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “ব্রেকিং নিউজ। এই লোকের নাম শিব সংকর দাস। তিনি বাংলাদেশী না। ভারতীয় নাগরিক। র এর সদস্য। তাকে এসাইন করা হয়েছিল নুর কে মেরে ফেলতে।..”

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ছবিটি নুরুল হক নুরকে হত্যা করতে শিব শংকর দাস নামে এসাইন হওয়া কারোর ছবি নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে পল্টন থানার ওসির গাড়িচালক পুলিশ কনস্টেবল মিজানুর রহমানের ছবি ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা ছবি শিব শংকর দাসের ছবি দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটি নিয়ে রিভার্স সার্চে মূলধারার গণমাধ্যম ‘ইনকিলাব’ এর ওয়েবসাইটে ‘লাল গেঞ্জি পরা যুবক পল্টন থানার ওসির গাড়িচালক’ শিরোনামে গত ৩১ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায় যার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটির তুলনা করলে মিল পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের ওপর নির্বিচারে লাঠিপেটার ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ওই যুবক রাজধানীর পল্টন থানার ওসির গাড়িচালক মিজানুর রহমান। গতকাল শনিবার (৩০ আগস্ট) পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই পুলিশ কনস্টেবলকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।… পুলিশ সূত্র বলছে, কনস্টেবল মিজানুর রহমান (বিপি নম্বর- ৯৭১৭১৯৭২৪৩) পল্টন থানার গাড়িচালক। তিনি বর্তমানে থানার ওসি নাসিরুল আমীনের গাড়ি চালান। ঘটনার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। তার অবস্থান শনাক্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে কাজ করছে। তবে পুলিশের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, কনস্টেবল মিজানুর রহমান পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। তার সাথে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে। তা নিয়ে তদন্তে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।…অন্যদিকে গুঞ্জন ছিল ওই যুবক ডিবিতে কর্মরত ছিলেন। তবে ডিবির প্রধান শফিকুল ইসলাম জানান, ওই যুবক ডিবির কেউ না। তবে সম্রাটকে মারধর করা কনস্টেবল মিজানুর রহমান এখন কোথায় জানতে যোগাযোগ করা হলে পল্টন থানার ওসির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।”
এছাড়াও, কনস্টেবল মিজানুর রহমানকে নিয়ে করা নানা পোস্টেও আলোচিত ছবিটির সংযুক্তি পাওয়া যায়।
উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে মূলধারার গণমাধ্যম ‘দৈনিক আমাদের সময়’ এর ওয়েবসাইটে ‘মেরুন পোলো শার্ট পরা সেই ব্যক্তি পল্টন থানার ওসির ড্রাইভার’ শিরোনামে গত ৩০ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাজধানীর পল্টনে গতকাল শুক্রবার (২৯ আগস্ট) মারধরের শিকার হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ দলটির নেতাকর্মীরা। ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মেরুন রঙের পোলো শার্ট পরা এক যুবক এক কর্মীকে মারধর করছেন। ভিডিওটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। মেরুন রঙের পোলো শার্ট পরা ব্যক্তি কে, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই মেরুন রঙের টি-শার্ট পরিহিত ব্যক্তি পুলিশ কনস্টেবল মিজানুর রহমান। তিনি পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসিরুল আমীনের গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অনেকেই দাবি করেন, নুরকে পিটিয়েছেন মিজানুর। তবে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ভিডিওতে দেখা পোশাকধারী ব্যক্তি নুরকে নয়, ছাত্রনেতা সম্রাটকে মারধর করেছিলেন।”
প্রতিবেদনে সংঘর্ষকালীন সময়ে ধারণকৃত মিজানুর রহমানের একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। ছবিটির সাথে আলোচিত দাবিটি প্রচারিত ছবিটির তুলনা করলে পোশাক, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মুখমণ্ডলের মিল পাওয়া যায়।

তবে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলে মুখমন্ডলের গঠন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় খানিকটা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয় যা সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি ছবিতে দেখা যায়। এ থেকে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিটি মূলত কনস্টেবল মিজানুর রহমানের ছবি ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।

পরবর্তীতে এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে এআই কনটেন্ট শনাক্তকরণ প্ল্যাটফর্ম হাইভ মডারেশনে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটি যাচাই করলে ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ৭৯.৭ শতাংশ দেখা যায়। এছাড়াও, এআই ও ডিপফেক কনটেন্ট শনাক্তকরণ আরেক প্ল্যাটফর্ম ‘ডিপফেক ও মিটার’ এও আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটি বিশ্লেষণ করলে ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি বা ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিটি মূলত এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি। এছাড়াও, অনুসন্ধানে আলোচিত ছবিটি শিব শংকর দাস নামে কারোর বা নুরুল হক নুরকে হত্যার উদ্দেশ্যে শিব শংকর দাস নামে কারোর দায়িত্ব পাওয়ার দাবির সপক্ষেও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, পল্টন থানার ওসির গাড়িচালক পুলিশ কনস্টেবল মিজানুর রহমানের ছবি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করে তা নুরুল হক নুরকে হত্যা করতে দায়িত্ব পাওয়া ‘র’ সদস্য শিব শংকর দাসের ছবি দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Inqilab – লাল গেঞ্জি পরা যুবক পল্টন থানার ওসির গাড়িচালক
- Dainik Amader Shomoy – মেরুন পোলো শার্ট পরা সেই ব্যক্তি পল্টন থানার ওসির ড্রাইভার
- Hive Moderation
- DeepFake-O-Meter