তাজমহল নির্মাণের পর শ্রমিকদের কি হাত কাটা হয়েছিল?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ শ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিলেন” শীর্ষক একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাবিটি সত্য নয় কেননা দাবির পক্ষে যথার্থ কোনো প্রমাণ নেই বরং কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই তথ্যটি প্রচার করা হচ্ছে।

দাবিটির সূচনালগ্ন

ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান অল্টনিউজকে বলেছেন, এই শহুরে পৌরাণিক কাহিনীটি ১৯৬০ এর দশকে থেকে শুরু হয়েছে এবং আমি এটি মানুষের মুখে মুখে শুনেছি।

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্যটি প্রকাশের সূচনা

ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই ভুল তথ্যটি ভারতে প্রাথমিকভাবে উদ্ভব ও পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের মুখে মুখে ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। অনুসন্ধানে বাংলাদেশে; বিশেষ করে বাংলা ভাষায় ফেসবুকে ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল থেকে এই তথ্যটির প্রচারণার তথ্য পাওয়া যায়। পাশাপাশি পরবর্তী বছরগুলোতেও ধীরে ধীরে তথ্যটি প্রচার হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে পরবর্তী প্রতিবছরের প্রথম পোস্টগুলো হচ্ছে ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ১লা মে, ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী,  ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি, ২০১৯ সালের ১লা মে, ২০২০ সালের ২৮ আগষ্ট, ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল, ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। 

বিষয়টি সম্পর্কে ঐতিহাসিক রিসার্চ জানার জন্য অনুসন্ধান করে, গুগল বুকস-এ ১৯৭১ সালে রাঁচি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চ’-এর ডিজিটালি সংরক্ষিত কপি খুঁজে পাওয়া যায়। জার্নালে উল্লেখ করা হয়, কাহিনিটি একটি শহুরে কিংবদন্তী। 

পাশাপাশি, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম “দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া”-এ ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর “তাজের (তাজমহলের) ভুয়া খবর ফাঁস [অনুবাদিত]”  শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই গল্পটি উপলব্ধ (প্রচুর পরিমাণের) প্রমাণ এবং তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।

মূলত, শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ শ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিলেন এটি বহু বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত একটি শহুরে মিথ। এই দাবির স্বপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়না। দাবিটি কোনো তথ্য প্রমাণ ব্যতীত প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়াও ভারতীয় মূলধারার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম-ও দাবিটিকে শহুরে মিথ বা প্রচলিত গল্প হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ভারতে সমজাতীয় তাজমহল সম্পর্কিত আরও কিছু প্রচারণা

  • ২০১৭ সালের জুনে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন যে তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে না
  • বিধায়ক সঙ্গীত সোম এটিকে “ভারতের উপর দাগ” বলে অভিহিত করেছেন।
  • বিজেপির আরেক সিনিয়র নেতা বিনয় কাটিয়ার তাজমহলকে ‘তাজ-ই-এ-হিন্দু-মন্দির’ বলে দাবি করেছেন।

গণমাধ্যমে আলোচিত দাবিকে মিথ্যা এবং শহুরে মিথ হিসেবে প্রতিবেদন

ভারত এবং পাকিস্তানের বেশকিছু মূলধারার গণমাধ্যম আলোচিত দাবিটি মিথ্যা কিংবা শহুরে মিথ হিসেবে প্রমাণ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেমন; ভারতের দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, ডেকান হেরাল্ড  এবং পাকিস্তানের “দ্য ডন”।

গণমাধ্যমে আলোচিত দাবিটি প্রকাশ

আলোচিত দাবিটি শহুরে মিথ হিসেবে এতই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল যে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও লেখালেখি হয়েছিল (ভুল তথ্যটি)। তাজমহল শ্রমিকদের হাত কেটে ফেলার ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম “দ্য গার্ডিয়ান” এর অনলাইন ভার্সনে এবং ম্যাগাজিন “উইয়ার্ড” এর টুইটারে যথাক্রমে প্রতিবেদন ও পোস্ট প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি ভারতীয় গণমাধ্যম নিউজ এইটিন-এ একই ভুল তথ্যটি প্রচার করা হয়েছিল।

যে কারণে ভারত জুড়ে দাবিটি পুনরায় আলোচনায়

২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির উদ্বোধন করতে গিয়ে একই অনুষ্ঠানে মন্দিরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নিয়োজিত কর্মীদের গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে সম্মান জানান। এই অনুষ্ঠানটি প্রচারের সময়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটটিনের উপস্থাপক আমিশ দেবগন আলোচিত দাবিটি উল্লেখ করে তুলনা করেন। তুলনায় আমিশ বলেন, ‘ মোদি মন্দিরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়েছেন, আর শাহজাহান তাজমহল নির্মাতাদের হাত কেটে দিয়েছিলেন।’

পাশাপাশি বিশ্বনাথ মন্দির উদ্বোধনের পরেরদিন  বিজেপি নেতা বিনয় টেন্ডুলকার মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটারে একই দাবি পোস্ট করেন। 

এর কয়েকদিন পরে ভারতের গুজরাটে একটি সভায় একই গল্প (আলোচিত দাবি) উপস্থাপন করেন দেশটির কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তমার। গুজরাটি ভাষায় তিনি বলেন, ‘তাজমহলের কর্মীদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদি কাশী বিশ্বনাথ ধামের উন্নয়নে যারা কাজ করছেন তাদের ওপর ফুল ছিটিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।’ 

Collected Image

উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন যে তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে না, এরপর সেই প্রদেশের পর্যটন বুক থেকে তাজমহলের নাম সরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও, তাজমহলের সরকারি ওয়েবসাইটেও হাত কেটে নেয়ার ব্যাপারে কোনো তথ্য উল্লেখ করা নেই। পাশপাশি, তাজমহল ভ্রমণ সম্পর্কিত সাইটে তাজট্যুরস-এ হাত কেটে নেয়ার বিষয়টিকে মিথ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান অল্টনিউজদ্য লজিক্যাল ইন্ডিয়ান

সুতরাং, শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ শ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিলেন শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img