হাদীস নিয়ে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার

সম্প্রতি “নবী মুহম্মদের মৃত্যুর পর রচিত কোন হাদিসই সত্য ও বৈধ নয়: মুহাম্মদ বিন সালমান” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নবী মুহম্মদের মৃত্যুর পর রচিত কোন হাদিসই সত্য ও বৈধ নয় দাবিতে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের প্রচারিত উক্তিটি তিনি বলেননি বরং ২০২১ সালের এপ্রিলে সৌদি গণমাধ্যম Al- Arabiya কে দেয়া সৌদি যুবরাজের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের একটি অংশকে ভুল ব্যাখ্যা করে প্রচার হচ্ছে।

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে সৌদি গণমাধ্যম Al Arabiya English এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল “Saudi Crown Prince Mohammed bin Salman Interview on vision 2030” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি সাক্ষাৎকার প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই সাক্ষাৎকার প্রতিবেদনটি ছিল সৌদি আরবের সৌদি ভিশন -২০৩০ নিয়ে। আল-আরাবিয়া সৌদি যুবরাজের এই সাক্ষাৎকারটিকে তিন অংশে ভাগ করে ইউটিউবে প্রচার করে। তৃতীয় ভাগের শুরুতেই উপস্থাপকের  সংবিধান সংশ্লিষ্ট একটি প্রশ্নের উত্তরে প্রসঙ্গ ক্রমে হাদীস নিয়ে আলোচনা করেন সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদি গণমাধ্যম Al- Arabiya কে দেয়া তাঁর এই ভিডিও সাক্ষাৎকারের লিখিত রূপও গণমাধ্যমটি ২ এপ্রিল “Transcript: Saudi Crown Prince Mohammed bin Salman’s full interview on Vision 2030” শীর্ষক শিরোনামে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সৌদি যুবরাজ কোরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনা ছাড়া শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করতে পারেন না বলে অভিমত প্রকাশ করেন৷

তিনি বলেন, যখন হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনার কথা আসে তখন দেখা যায়, অধিকাংশ হাদীস লেখকেরা হাদীসকে নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করেছেন যেমন বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্যরা। তবে হাদীসের শ্রেণিকরণের জন্য সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো হাদীসটি কি অনেকের দ্বারা বর্ণিত হয়েছে নাকি বর্ণনাকারী কেবল একজন? এবং শরীয়া ভিত্তিক আইন হিসেবে গ্রহণের জন্য এটাই মূল সূত্র।

পরবর্তীতে তিনি বলেন, যখন আমরা মুতাওয়াতির হাদীস নিয়ে কথা বলি, এ ধরনের হাদীসগুলো সংখ্যায় কম তবে বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে এই হাদীসগুলোর বিশুদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। এই ধরনের হাদীসগুলো রাসূল সা. থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়ে এসেছে।

আবার আমরা যখন আহাদ হাদীস নিয়ে আলোচনা করি, এটিকেও নানাভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন, দুর্বল, সঠিক ও প্রসিদ্ধ হাদীস। তবে এই হাদীসগুলো মুতাওয়াতির হাদীসের মতো প্রভাবশালী নয়।

পরবর্তীতে তিনি হাদীসের আরেকটি প্রকার  “Khabar” হাদীস নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, “Khabar” হল এমন হাদীস, যা একজন একক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তির কাছে এসেছে অজানা সূত্রে যেটা হতে পারে সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অথবা একটি দল থেকে একটি দলে, তারপর একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে। 

ফলে এখানে হাদীসের বর্ণনার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়েছে। এই ধরনের হাদীসগুলোর সংখ্যা অনেক হলেও এগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়, এই অর্থে যে এর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং এটি বাধ্যতামূলকও নয়।

পাশাপাশি তিনি আরও বলেন,  সরকার ও শরিয়া সম্পর্কিত বিষয়ে মুতাওয়াতির হাদিস ও  কুরআনের বিধিবিধান, শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। আহাদ হাদীসগুলোর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা খতিয়ে দেখতে হবে এবং “খবর” হাদিসগুলিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে হবে, যদি না তা থেকে মানবতার জন্য একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া না যায়।

এছাড়া তিনি তার বক্তব্যে আরও বলেন, নবী করীম সা.র জীবদ্দশায় যখন হাদিসটি প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই নথিগুলোকে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং হাদিস লিখতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন এবং এটি আরও বেশি প্রযোজ্য হওয়া উচিত “খবর” হাদীসের ক্ষেত্রে। যাতে মানুষ এগুলোকে শরীয়াতের উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।

অর্থাৎ সৌদি যুবরাজের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, তিনি মূলত ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে হাদীস নেওয়ার ক্ষেত্রে তার বিশুদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি নবী মুহাম্মদ সা. এর  মৃত্যুর পর রচিত কোন হাদিসই সত্য ও বৈধ নয় এমন কোনো বক্তব্য তিনি দেননি।

অপরদিকে দেখা যায়, মহানবী সা. এর জীবদ্দশায় কোনো হাদীস সংকলন করা হয়নি বরং এ ব্যাপারে মহানবীর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ/বিএসএস প্রোগ্রামের ইসলামিক স্ট্যাডিজ ১: উলূমূল কোরআন ও উলূমূল হাদীস এর পাঠ্যক্রমে হাদীস সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় দেখা যায়, মহানবী সা. হাদীস লেখা রাখতে নিষেধ করেছেন এবং লিখে থাকলে তা মুছে ফেলতে বলেছেন। যাতে তা কোরআনের সাথে মিশে না যায়৷ 

কারণ, রাসূল সা. এর পুরো জীবদ্দশাতেই তার উপর কুরআন মাজীদ নাযিল হতো। আর পবিত্র কুরআন তখন লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল। তাই হাদীস লিখে রাখলে কুরআনের সাথে মিলে যেতে পারে -এ ভয়ে হাদীস গ্রন্থাকারে সংরক্ষণ করা তখন নিষেধ ছিল।

তবে মহানবী সা. এর মৃত্যুর পর ও সাহাবায়ে কিরামের যুগের শেষের দিকে খারেজী, রাফেজী, মু’তাযিলা ও বিদ’আতী প্রভৃতি মতবাদের উদ্ভব হলে তারা অনেকেই মহানবীর (স) হাদীসে পরিবর্তন এনে হাদীস বর্ণনা শুরু করেন। এমন যুগসন্ধিক্ষণে হাদীসের সত্যাসত্য নির্বাচন একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে। এ সময়ও বেশ কিছু সাহাবী জীবিত ছিলেন। তাদের থেকেই সঠিক হাদীস সংরক্ষণ কর্ম শুরু হয়।

সর্বপ্রথম হাদীসশাস্ত্র সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের কাজে কে এগিয়ে এসেছেন, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) ও হযরত রাফে ইবনে খাদীজ (রা) প্রথম হাদীস সংরক্ষণ করার ব্যাপারে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে কাজ শুরু করেন। 

এ সময় অনেক সাহাবীই হাদীস সংরক্ষণে আপন শক্তি ব্যয় করেন। এভাবে হিজরী প্রথম শতকের শেষের দিকে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) তাঁর খিলাফতকালে মদীনার বিচারক ইবনে হাজমকে হাদীস সংরক্ষণ ও গ্রন্থায়নের নির্দেশ প্রদান করেন। এ সময় থেকে প্রধানত হাদীস লিখন শুরু হয়। এদিক থেকে হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীম ছিলেন প্রথম হাদীসের সংগ্রাহক আর ইবনে শিহাব যুহরী ছিলেন হাদীস সংরক্ষণের প্রথম রূপকার।হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীযের ইন্তেকালের পর হাদীস সংরক্ষণের কাজ আরো বেগবান হয়। 

অর্থাৎ, রাসূল সাঃ এর মৃত্যুর পর মূলত তার হাদীসগুলো সংকলন করা হয়। তবে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলোতে প্রচারিত “রচিত” অর্থ নতুন করে রচনা করা, তৈরি করা বোঝালে, কেউ যদি নিজে রচনা করে তা  হাদীস হবে না।

মূলত, ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে কোরআন- হাদীসের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান হাদীসের বিভিন্ন প্রকার নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, সরকার ও শরিয়া সম্পর্কিত বিষয়ে মুতাওয়াতির হাদিস ও  কুরআনের বিধিবিধান, শিক্ষাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। আহাদ হাদীসগুলোর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা খতিয়ে দেখতে হবে এবং “খবর” হাদিসগুলিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে হবে, যদি না তা থেকে মানবতার জন্য একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া না যায়।

সুতরাং, নবী মোহাম্মদ এর  মৃত্যুর পর রচিত কোন হাদিস ই সত্য ও বৈধ নয় শীর্ষক যে বক্তব্যটি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এর বক্তব্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

Al- Arabiya Youtube: Saudi Crown Prince Mohammed bin Salman Interview on vision 2030

Al- Arabiya website: Transcript: Saudi Crown Prince Mohammed bin Salman’s full interview on Vision 2030

হাদীস সংকলনের ইতিহাস: ইসলামিক স্ট্যাডিজ ১: উলূমূল কোরআন ও উলূমূল হাদীস 

আরও পড়ুন

spot_img