হাবিপ্রবিতে মুসলমান শিক্ষার্থী কর্তৃক পূজা মণ্ডপ ভাঙচুর ও হিন্দু শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি

সম্প্রতি, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান শিক্ষার্থী কর্তৃক হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও স্বরস্বতী পূজা মণ্ডপ ভাঙচুর করা হয়েছে দাবিতে একটি ভিডিও এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচার করা হয়েছে।

পূজা মণ্ডপ ভাঙচুর

এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রকাশিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) মুসলমান শিক্ষার্থী কর্তৃক স্বরস্বতী পূজা মণ্ডপ ভাঙচুর কিংবা হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ঘটনা ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, হাবিপ্রবিতে স্থায়ী মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এর প্রতিবাদে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত পূজাস্থলের বাহিরে একটি অস্থায়ী মন্দির স্থাপন করে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত মন্দির স্থাপন করায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উক্ত মন্দির অপসারণের চেষ্টা করলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের সাথে প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বাদানুবাদ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার ভিডিওকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শেখ রাসেল মাঠে আয়োজিত পূজার অনুষ্ঠানে কোনো হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

প্রচারিত দাবি ও ভিডিওর বিষয়ে অনুসন্ধানে কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মূলধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস’ এর ওয়েবসাইটে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি “হাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে মন্দির স্থাপন নিয়ে মুখোমুখি শিক্ষার্থী-প্রশাসন” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবির সাথে আলোচিত ভিডিওর দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়।

Comparison Image By Rumor Scanner

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হল মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্বরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। পূজা চলাকালীন পূজায় অংশ নেওয়া একদল শিক্ষার্থী পূজাস্থল থেকে মন্দির স্থাপনের জন্য মাইকে ঘোষণা দেয়। এরপর কয়েকজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে স্থাপিত হাবিপ্রবি স্কুলের দক্ষিণ দিকে, বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হল সংলগ্ন মাঠের উত্তর পাশের একটি স্থানে বাঁশ ও পতাকা দিয়ে অস্থায়ী মন্দির স্থাপন করে। 

পরবর্তীতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ নব্য স্থাপিত মন্দির এলাকায় গেলে উপস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের সাথে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। 

অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে ভিডিওটি পূঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে উল্লিখিত দাবির সত্যতা পাওয়া যায়। ভিডিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মামুনুর রশীদ এবং ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহাবুব হোসেনকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের সাথে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতিতে জড়ানোর পাশাপাশি অস্থায়ী মন্দিরের স্থাপনা অপসারণের চেষ্টা করতে দেখা যায়।

Indication By Rumor Scanner

উল্লেখ্য, ভিডিওর কোথাও মুসলমান ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী কর্তৃক হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা কিংবা মন্দির ভাঙচুর করতে দেখা যায়নি।

প্রক্টরের বক্তব্য

উক্ত ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মামুনুর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, “ওই স্থানে মন্দির নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কোনো অনুমতি নেই। তারা জোরপূর্বক নির্মাণের চেষ্টা করছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ। কোনো শিক্ষার্থী বা সংগঠন চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ব্যতিরেকে যত্রতত্র মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা বা ক্লাবের জন্য জায়গা নির্ধারণ বা স্থাপনা নির্মাণের এখতিয়ার রাখে না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের পূজা উদযাপন কমিটির বক্তব্য

আলোচিত দাবির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরস্বতী পূজা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড.শ্রীপতি শিকদার ও সদস্য সচিব কৃষ্ণ চন্দ্র রায় সাক্ষরিত একটি বিবৃতি খুঁজে পাওয়া যায়।

Source: আমার সংবাদ

উক্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, “অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা চলাকালীন পূজা মণ্ডপ  ভাঙ্গা ও হিন্দু-মুসলিম শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষ নিয়ে ভুয়া এবং বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) এ ‍‍`Hindu Voice‍‍` ‍‍`Voice of Bangladeshi Hindus‍‍` সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ছড়ানো হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর।

উক্ত যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় যেসব তথ্য প্রমাণ (ছবি ও ভিডিও) তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো মন্দিরের দাবিতে আন্দোলনরত সনাতন শিক্ষার্থীদের সাথে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কথোপকথনের চিত্র যা অনুষ্ঠিত সরস্বতী পূজা উদযাপনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এ ধরনের তথ্য প্রকাশের আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সত্যতা যাচাইপূর্বক প্রকাশের জন্য অনুরোধ করা হলো।”

হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা কী বলছে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী রিউমর স্ক্যানারকে জানান, হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি-মন্দির প্রতিষ্ঠার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুল মাঠসংলগ্ন এলাকায় একটি অস্থায়ী মন্দির স্থাপন করে। পরবর্তীতে প্রশাসনের লোকজন এসে অস্থায়ী মন্দির উচ্ছেদ করতে চাইলে বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তবে, শেখ রাসেল হল মাঠে স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে তৈরিকৃত মণ্ডপ ভাঙচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর ঘটনার সাথে মুসলমান ছাত্রদেরও কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের ভাষ্য কি?

উক্ত দাবির সত্যতা যাচাইয়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মো: তানভির আহমেদের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি জানান, সেদিনের ঘটনায় শেখ রাসেল হল মাঠে স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে তৈরিকৃত মণ্ডপ ভাঙচুরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে সেদিন ক্যাম্পাসে প্রশাসন ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে। কিন্তু মুসলমান শিক্ষার্থীদের উক্ত ঘটনার সাথে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন তিনি।

অর্থাৎ, হাবিপ্রবিতে মন্দির স্থাপনকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বাগবিতণ্ডার ঘটনা ঘটেছে।

মূলত, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ রাসেল হল মাঠে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। পূজা চলাকালীন সময়ে পূজায় অংশ নেওয়া একদল শিক্ষার্থী দীর্ঘদিনের দাবি স্থায়ী মন্দির প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গড়িমসির প্রতিবাদে পূজাস্থল থেকে মন্দির স্থাপনের জন্য মাইকে ঘোষণা দেয়। এরপর কয়েকজন শিক্ষার্থী বাঁশ, লাল ও গেরুয়া রঙের পতাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে স্থাপিত হাবিপ্রবি স্কুলের দক্ষিণ দিক, বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হল সংলগ্ন মাঠের উত্তর পাশের স্থানটিতে বাঁশের খুঁটি ও পতাকা স্থাপন করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যক্তিরা সেখানে গিয়ে বিষয়টিকে অবৈধ ও বেআইনিভাবে স্থান দখল দাবি করে অস্থায়ী মন্দির উচ্ছেদ করতে চাইলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে, সে ঘটনার একটি ভিডিওকে হাবিপ্রবিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ওপর মুসলমান শিক্ষার্থীদের হামলা ও মুসলমান শিক্ষার্থী কর্তৃক স্বরস্বতী পূজা মণ্ডপ ভাঙচুরের ভিডিও দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়।

সুতরাং, হাবিপ্রবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তৈরিকৃত অস্থায়ী মন্দিরের স্থাপনা অপসারণ চেষ্টাকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যক্তিদের সাথে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ভিডিওকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ওপর মুসলমান শিক্ষার্থীদের হামলা ও মুসলমান শিক্ষার্থী কর্তৃক স্বরস্বতী পূজা মণ্ডপ ভাংচুর করা হয়েছে দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img