দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বিয়ের আংটি বাম হাতের তৃতীয়/চতুর্থ আঙুলে কেন পড়ানো হয়, কারণ এটি একমাত্র আঙ্গুল যার স্নায়ু সরাসরি আমাদের হৃদয়ের সাথে অর্থাৎ হৃদযন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকে।’ শীর্ষক একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে।

বিয়ের আংটি কেবল বাম হাতের তৃতীয় আঙুলে পরানোর দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

বিয়ের আংটি কেবল বাম হাতের চতুর্থ আঙুলে পরানোর দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাম হাতের তৃতীয় বা চতুর্থ আঙ্গুলই একমাত্র নয়, যার শিরার সাথে হার্ট বা হৃৎপিণ্ডের সরাসরি সংযুক্তি আছে বরং হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুলই শিরার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত। প্রকৃতপক্ষে বিয়ের আংটি বাম হাতের একটি নির্দিষ্ট আঙুলে পরানোর পেছনে আছে প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস, যেখানে মনে করা হতো ঐ একটি আঙুলের শিরাই সরাসরি হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত এবং এই শিরাটিকে বলা হয় Vena Amoris বা Vein of Love।
হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুলই শিরার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত
আলোচিত দাবিটি নিয়ে আলোচনার পূর্বে হৃৎপিণ্ডের কাজ ও দেহের রক্ত সংবহনতন্ত্র নিয়ে মৌলিক কিছু আলোচনা করা যাক।
রক্ত সংবহনতন্ত্র হলো হৃৎপিণ্ড, রক্তনালী এবং রক্তের সমন্বয়ে গঠিত একটি তন্ত্র। হৃৎপিণ্ডের অবিরাম সংকোচন এবং প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সংবহন পদ্ধতি অব্যাহত থাকে।
এই রক্ত সংবহন পদ্ধতি যেসব নালীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তাকে রক্তনালী বা রক্তবাহিকা (Blood Vessel) বলে। গঠন, আকৃতি এবং কাজের ভিত্তিতে রক্তবাহিকা বা রক্তনালী তিন ধরনের হয়ে থাকে। যথা, ধমনি, শিরা এবং কৈশিক জালিকা।
এর মধ্যে ধমনির মাধ্যমে সাধারণত অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে সারাদেহে প্রবাহিত হয় এবং শিরার মাধ্যমে রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। এরা ধমনির মতোই সারা দেহে ছড়িয়ে থাকে।

আমাদের পুরো মানবদেহ অর্থাৎ হাতের প্রত্যেকটি আঙ্গুলও শিরা (vein) এবং ধমনির (Artery) মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত।
মানুষের হাতের গঠনতন্ত্র নিয়ে আরও বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমাদের হাতদ্বয় বিভিন্ন উপাদান যেমন হাড়, পেশী এবং নরম টিস্যু দ্বারা গঠিত।

এছাড়া হাতদ্বয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো রয়েছে যা রক্তনালী হিসাবে পরিচিত, যেমন ধমনী এবং শিরা। এই রক্তনালীগুলো হাত থেকে হৃৎপিণ্ডে এবং হৃৎপিণ্ড থেকে হাতে রক্ত বহন করার জন্য এবং হাতের অন্যান্য উপাদানগুলোকে কর্মক্ষম করে রাখে, যা আমাদের হাতদ্বয়কে নড়াচড়া করতে এবং বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম করে তোলে।
হাতের গঠনতন্ত্রের আরও বিস্তারিত ছবি দেখুন এখানে।

এই ছবি থেকেও বুঝা যায়, হাতের আঙুলের শিরাগুলো বড় একটি শিরার সাথে যুক্ত হয়ে অবশেষে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছেছে।
এছাড়া ভিজিবল বডি নামের একটি শিক্ষামূলক ওয়েবসাইটে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি ‘Anatomy and Physiology: 5 Medical Myths Demythified!’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হাতের কেবল একটি শিরাই সরাসরি হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত নয়, বরং প্রত্যেকটি আঙুলের শিরাই হৃৎপিণ্ডের সাথে যুক্ত। মূলত এই বিশ্বাসটির উৎপত্তি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় এবং ঐ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই এখনো বিয়ের সময় এভাবে আংটি পরানো হয়। প্রকৃতপক্ষে Vena Amoris বা Vein of Love নামে কোনো শিরার অস্তিত্ব নেই।

বিয়ের আংটি বাম হাতের অনামিকায় পরার মিথ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, বিয়ের আংটি বাম হাতের একটি নির্দিষ্ট আঙুলে পরানোর ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে তথ্যটি প্রচার হয়ে আসছে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও এ দাবির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায়।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, বাম হাতের চতুর্থ আঙ্গুলটির শিরা সরাসরি হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা ও এজন্যই এ আঙুলে আংটি পরানোর প্রথাটির সূচনা প্রাচীন মিশরে।

পরবর্তীতে এ প্রথা ছড়িয়ে পড়ে রোমান ও গ্রীকদের মধ্যেও। এই শিরাকে তারা নাম দেয় Vena Amoris। তবে মিশরের সভ্যতা বিশেষজ্ঞ ড. ফ্লোরা অ্যান্থনি বলেন, বিয়েতে আংটি পরানো কোনো প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা নয়। প্রাচীন মিশরে বিয়েতে এই ধরনের অনুসঙ্গ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

তিনি পুরো বিষয়টিকেই বিশেষ করে প্রাচীন মিশরের অংশটিকে মিথ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
সাধারণ লোককাহিনী এবং কুসংস্কারের উপর ১৯৩২ সালে লেখা ‘The hand of destiny : the folk-lore and superstitions of everyday life’ শীর্ষক একটি বইয়ে ব্রিটিশ লেখক চার্লস থম্পসন সতের শতকের লেখক টমাস ব্রাউনকে উদ্ধৃত করে লিখেন, আংটি পরানোর জন্য চতুর্থ আঙুলটি বেছে নেওয়া হয়েছিল, কারণ এই আঙুলের একটি নির্দিষ্ট স্নায়ু, শিরা বা ধমনী হৃৎপিণ্ড থেকে সরাসরি সেখানে পাঠানো হয়।
তবে একই বইয়ে বাম হাতের চতুর্থ আঙুলে আংটি পরানোর বিষয়ে তিনি ভিন্ন আরেকটি মতও উল্লেখ করেন। বইটির ৫৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন, ‘ডান হাতের তুলনায় নিকৃষ্টতার কারণে বাম হাতটি বিয়ের আংটির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল।

বাম হাতের অনামিকায় আংটি পরানোর বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কপিরাইটার এবং লেখক লিলিয়ান আইখলার ১৯২৪ সালে তার লেখা The Customs of Mankind বইয়ের ২৩৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেন, “স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্যতা বোঝাতে বাম হাতে আংটি পরা হয়।’’ তবে একই বইয়ে বাম হাতের চতুর্থ আঙুলে আংটি পরার সম্ভাব্য আসল কারণ উল্লেখ করে তিনি লিখেন, “সম্ভবত এই আঙুলে আংটি পরার আসল কারণ, এটি সমস্ত আঙুলের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত হয়।”
এসব দাবি ছাড়াও বাম হাতের অনামিকায় আংটি পরানোর বিষয়ে আরও একটি দাবি খুঁজে পাওয়া যায়। এই দাবি অনুসারে, বিয়ের সময় চার্চে খ্রিস্টান যাজক বিয়ের আংটি নিয়ে পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার নামে কনের বাম হাতের প্রথম তিনটি আঙুলে স্পর্শ করিয়ে চতুর্থ আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়।

মূলত, ইন্টারনেটে দীর্ঘদিন ধরেই ‘বিয়ের আংটি বাম হাতের তৃতীয়/চতুর্থ আঙুলে পরানোর কারণ হিসেবে একটি তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে এটিই হাতের একমাত্র আঙ্গুল, যার স্নায়ু সরাসরি আমাদের হৃদযন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটি বহু যুগ ধরে চলে আসা একটি প্রচলিত মিথ। বিয়ের আংটি বাম হাতের তৃতীয়/চতুর্থ আঙুলে পরানোর কারণ হিসেবে প্রচারিত দাবিটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বরং হাতের প্রতিটি আঙুলের সাথেই হৃৎপিণ্ডের সংযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘বিয়ের আংটি বাম হাতের চতুর্থ আঙুলে পরানোর কারণ হিসেবে প্রচারিত তথ্যটি নিয়ে আফ্রিকা ভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Africa Fact Check এর প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
সুতরাং, ‘বিয়ের আংটি বাম হাতের তৃতীয়/চতুর্থ আঙুলে পরানোর কারণ হিসেবে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- 10 Minute School: হৃৎপিণ্ডের গঠন ও কাজ এবং রক্তবাহিকা
- Visible Body: ‘Anatomy and Physiology: 5 Medical Myths Demythified!
- National Library of Medicine: A Plastic Surgeon’s Vena Amoris
- I Stock: Vein plotting in the arm illustration vector on white background. Medical concept. stock illustration.
- Florida Orthopedic Institute:
- REVASCULARIZATION OF THE HAND
- Big Think:
- How Europeans wear wedding rings, and what it says about them
- The hand of destiny : the folk-lore and superstitions of everyday life: The Customs of Mankind
- The Customs of Mankind:
- The Customs of Mankind
- Africa Fact Check: Ring of truth? No, all fingers have veins leading to heart, not just ‘ring’ finger