গত ২৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান (সিজেসিএসসি) জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা। এ সময় ড. ইউনূস তাকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন দেয়ালে শিক্ষার্থীদের আঁকা বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় গ্রাফিতি চিত্রের একটি সংকলন ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ বইটি উপহার দেন। যার প্রচ্ছদে বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত একটি গ্রাফিতি ব্যবহার করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে ড. ইউনূসের পাকিস্তানি জেনারেলকে বইটি উপহার দেওয়ার ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে তাকে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র উপহার দিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর ভারতের ‘চিকেন নেক’ ইস্যু নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ছবিটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন রিপাবলিক, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য ইকোনমিক টাইমস, এনডিটিভি, এবিপি নিউজ, নিউজ১৮, ইন্ডিয়া ডট কম এবং নর্থ ইস্ট লাইভ টিভি।
ফেসবুকে প্রচারিত একই দাবির পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যানকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বাংলাদেশের নতুন মানচিত্র উপহার দেওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, পাকিস্তানি জেনারেলকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি চিত্রের সংকলনে তৈরি ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ বইটি উপহার দেওয়া হয়। বইটির প্রচ্ছদেও শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি ব্যবহার করা হয়েছে। কাঁচা হাতে আঁকার কারণে গ্রাফিতিগুলো পেশাদারদের মতো নিখুঁত হয়নি। এ কারণে প্রচ্ছদে দেখতে পাওয়া মানচিত্রটিও কিছুটা বিকৃত হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে সেটিকেই ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
আলোচিত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে জাতীয় দৈনিক The Business Standard-এর ওয়েবসাইটে ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ বইটি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গ্রাফিতি সংকলিত বইটি প্রকাশ করে। বইটি প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল জুলাই আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের কাঁচা হাতে আঁকা গ্রাফিতিগুলোকে সংরক্ষণ করা। কারণ তা না করা হলে শিক্ষার্থীদের এই প্রচেষ্টা হারিয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বইটির অন্যতম প্রযোজক চিত্রশিল্পী মোরশেদ মিশুর বরাতে জানানো হয়, বইটির জন্যে চিত্রকর্ম সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোন গ্রাফিতি কতটা শৈল্পিকভাবে পরিমার্জিত ছিল তার উপর ভিত্তি করে তা বেছে নেওয়া হয়নি। বরং নতুন বাংলাদেশের ইতিবাচকতা, সাধারণ মানুষের আশা, দাবি এবং জেন-জি’র প্রত্যাশা তুলে ধরে এমন গ্রাফিতিগুলোকে বেছে নেওয়া হয়। এছাড়াও পেশাদার বা হাই-প্রোফাইল শিল্পীদের কাজগুলো তুলে ধরাও এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয় বলেও প্রতিবেদককে জানান তিনি।
অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, এই বইয়ের সাথে বা বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবির সাথে ভারত-বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়াও গ্রাফিতিগুলো শিক্ষার্থীদের কাঁচা হাতে আঁকা বলেও জানা যায়।
পরবর্তীতে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি সংকলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ বইটি পর্যালোচনা করে দেখে রিউমর স্ক্যানার। বইটিতে আলোচিত গ্রাফিতি ব্যতীতও একাধিক বিকৃত মানচিত্রের গ্রাফিতি দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও অন্যান্য গ্রাফিতিগুলোতে অপরিপক্কতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন স্থানে অঙ্কিত গ্রাফিতির আরও কিছু ছবি পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের একাধিক বিকৃত মানচিত্রের গ্রাফিতি পাওয়া যায়। যার প্রত্যেকটির আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। এমন কিছু গ্রাফিতি দেখুন-

মূলত গ্রাফিতিগুলো অপেশাদার শিক্ষার্থীদের হাতে আঁকা হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর সাথে ভূ-রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা থাকলে সকল মানচিত্র একই রকম হওয়া অনিবার্য্য ছিল।
পরবর্তীতে অনলাইন গণমাধ্যম জাগোনিউজ২৪-এর ওয়েবসাইটে ‘প্রতিবাদের গল্পগুলো আঁকা থাক দেওয়ালে দেওয়ালে’ শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদককে বদিউল হক নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় করা গ্রাফিতির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনগুলো সেসময় তাড়াহুড়ো করে করা হতো। ৫ আগস্টের আগে পুলিশ, ছাত্রলীগের হামলার ভয় নিয়েই গ্রাফিতি করা হয়েছে। বেশিরভাগ সময় মিছিলে চলতি অবস্থায় দ্রুত একটা স্লোগান লিখে চলে যেতাম তাই লিখনগুলো ততটা সুশ্রী হতো না।”
উল্লিখিত শিক্ষার্থীর বক্তব্য থেকে এটিও প্রতীয়মান হয় যে, কেনও সেসময় অপেশাদার শিক্ষার্থীদের হাতে আঁকা গ্রাফিতিগুলোর নিখুঁত নয়।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ বইটি শুধু পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান (সিজেসিএসসি) জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জাকে দেওয়ার বিষয়েই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুধু পাকিস্তানি জেনারেলই নয়, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে উক্ত বইটি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
অর্থাৎ, উপস্থাপিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে জুলাই আন্দোলনের সময় আঁকা শিক্ষার্থীদের কাঁচা হাতে আঁকা গ্রাফিতি নিয়ে দুই দেশের ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু টেনে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
সুতরাং, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশের একটি নতুন মানচিত্র তৈরি করে পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জাকে উপহার দিয়েছেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- The Business Standard Website: From the streets to the States: The story behind The Art of Triumph
- The Art of Triumph: Graffiti of Bangladesh’s New Dawn Book
- Shilpakala Website জুলাই বিপ্লব ২০২৪ এর আর্ট, গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন, দেয়াল চিত্র এবং ক্যালিগ্রাফির সংগৃহীত স্থিরচিত্র
- Bangladesh Rural Electrification Board-BREB Facebook Post
- Jagonews24 Website: প্রতিবাদের গল্পগুলো আঁকা থাক দেওয়ালে দেওয়ালে
- Rumor Scanner’s Analysis





