নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমির রোজা নিয়ে গবেষণা দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা

“রোজা রাখার উপকারিতা” শীর্ষক শিরোনামে কিছু তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। 

যা দাবি করা হচ্ছে

গত ৯ এপ্রিল ফেসবুকে ‘বিসমিল্লাহ’ নামক পেজে “রোজা রাখার উপকারিতা” শিরোনামে প্রকাশিত এক পোস্টে (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, “জাপানি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উসেনরি ওসমি। তিনি গবেষণা ও আবিষ্কার করেন যে, ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা রোজা রাখলে মানুষের দেহে অটোফেজি (Auto phazy) চালু হয়। তিনি প্রমাণ করেন যে, রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষ নিন্মুক্ত উপকারগুলো পান।
১) দেহের সেল পরিস্কার হয়।
২) ক্যান্সার সেল ধ্বংস হয়।
৩) পাকস্থলীর প্রদাহ সেরে যায়।
৪) ব্রেইনের কার্যকারিতা বাড়ে।
৫) শরীর নিজে নিজেই সেরে যায় ( Autophazy)।
৬) ডাইয়াবেটিস ভালো হয়।
৭) বাধ্যর্ক রোধ করা যায়।
৮) স্থুলতা দূর হয়।
৯) দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়।
১০) মানুষ ও জীবের প্রতি সহানুভূতি জন্মায়।”

সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

একই দাবিতে ২০২১ সালে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে।

একই দাবিতে ২০২০ সালে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে।

একই দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন ইনকিলাব (আর্কাইভ), zoombangla (আর্কাইভ), ডেইলি বাংলাদেশ (আর্কাইভ), সময় টিভি (আর্কাইভ), আমাদের সময় (আর্কাইভ), প্রতিদিনের সংবাদ (আর্কাইভ), বাংলা২৪ লাইভ নিউজপেপার (আর্কাইভ), প্রেস বাংলা এজেন্সি (আর্কাইভ)।

একই বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রকাশিত কলাম দেখুন বাংলাদেশ প্রতিদিন (আর্কাইভ),আজকালের খবর (আর্কাইভ) এবং নয়া দিগন্ত (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইয়োশিনোরি ওহশোমির গবেষণা দাবিতে রোজার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হওয়ার তথ্য সঠিক নয় বরং অধ্যাপক ইয়োশিনোরি ওহশোমি এমন মন্তব্য বা গবেষণা করেননি। 

অটোফেজি কী?

অটোফেজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটো ও ফাজেইন থেকে। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে, আত্ম ভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি হয়। ৩০% প্রোটিন সঠিকভাবে সংশ্লেষ হতে পারে না। ফলে এদের ধ্বংস করা, শরীর থেকে বের করে দেওয়া কিংবা অন্য উপায়ে কাজে লাগানো জরুরি। কেননা শরীরে এরা থাকলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হবে। আমাদের দেহ অটোফেজির মাধ্যমে এদের কাজে লাগায়। অটোফেজি প্রক্রিয়াটি আমাদের শরীরকে কার্যকরী করে রাখে, দুর্বল অঙ্গাণু থেকে মুক্তি দেয় এবং ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে। শরীরে এ প্রক্রিয়া অনুপস্থিত থাকলে ক্যান্সার কিংবা নানাবিধ স্নায়ুবিক রোগ হতে পারে।

রোজার মাধ্যমে অটোফেজি সক্রিয় হয়?

অটোফেজি সব সময়ই শরীরের মধ্যে ঘটে। তবে ব্যায়াম, রোজা বা উপবাস, ক্যালরি গ্রহণ সীমাবদ্ধ করা, বা কেটোজেনিক ডায়েট অনুসরণ করা প্রক্রিয়াটিকে উদ্দীপিত করতে পারে।

যদিও অটোফেজি বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সুবিধার সাথে যুক্ত তবে এটি লক্ষ রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এটিকে উদ্দীপিত করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো (যেমন, উপবাস, ক্যালরি কমানো বা কেটোজেনিক ডায়েট) অনুসরণ করা সবার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।

বিশেষত, বিরতিহীন উপবাস অনুশীলন করা বা কেটোজেনিক ডায়েট অনুসরণ করা সাধারণত কিশোর-কিশোরীদের, বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের, যারা গর্ভবতী বা খাওয়ার ব্যাধির ইতিহাস রয়েছে তাদের জন্য সুপারিশ করা হয় না।

তাছাড়া, যাদের ডায়াবেটিস বা অন্যান্য অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যের অবস্থা রয়েছে তাদের খাদ্যে কোনো পরিবর্তন করার আগে তাদের ডাক্তারের সাথে কথা বলা উচিত।

রোজা রাখার মাধ্যমে বা কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ সীমিত করার মাধ্যমে অটোফেজি অর্জনের সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলো চিন্তার কারণ হয়ে উঠলে বিকল্প পথ হিসেবে শারীরিকভাবে আরও সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ এসেছে স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট healthline এর এক প্রতিবেদনে। 

জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইয়োশিনোরি ওহশোমি পৃথিবীতে সর্ব প্রথম অটোফেজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ইউশিনোরি দেখিয়েছেন, কোষেরা নিজেরাই নিজেদের বর্জিতাংশ বা আবর্জনাকে আটকায়। এরপর সেখান থেকে উপকারী উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে ফেলে। তারপর ওই দরকারি উপাদানগুলো দিয়ে উৎপাদন করে শক্তি কিংবা গড়ে তোলে নতুন নতুন অনেক কোষ। এ মহৎ কাজ তাঁকে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।

ইয়োশিনোরি কি রোজা নিয়ে গবেষণা করেছেন? 

ইয়োশিনোরি অটোফেজি নিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে অসংখ্য গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন। তবে কোনো গবেষণাতেই বলা হয়নি, রোজা বা উপবাস ক্যান্সার সারাবে। একটানা কতক্ষণ না খেয়ে থাকা অটোফেজির জন্য বিজ্ঞান সম্মত, সে নির্দেশনাও ইয়োশিনোরির কোনো গবেষণায় নেই। 

ইয়োশিনোরি বর্তমানে জাপানের টোকিও ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’র ইন্সটিটিউট অফ ইনোভেশন রিসার্চ এর সেল বায়োলজি ইউনিটের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন। 

১২ থেকে ২৪ ঘন্টা রোজা বা উপবাসের মাধ্যমে মানবদেহে অটোফেজি সক্রিয় হওয়া, রোজার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হওয়া, স্থূলতা দূর হওয়া এবং ডায়াবেটিস ভালো হওয়া বিষয়ক তথ্যগুলো ইয়োশিনোরি’র গবেষণায় এসেছে কি না কিংবা তিনি এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেছেন কি না তা জানতে টোকিও ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

 ইন্সটিটিউটের জনসংযোগ শাখা থেকে রিউমর স্ক্যানারকে জানানো হয়, “অধ্যাপক ইয়োশিনোরি ওহশোমি এমন মন্তব্য কখনো করেননি।” 

রোজা কি মানবদেহে অটোফেজি চালু করে?

‘বিবিসি’র ২০১৮ সালের ৬ মে প্রকাশিত “Can the science of autophagy boost your health?” শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউকে ডিমেনশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আণবিক নিউরোজেনেটিক্সের অধ্যাপক ডঃ ডেভিড রুবিনসটেইন বলেছেন, “এমন অধ্যয়ন রয়েছে যেখানে গবেষকরা জেনেটিক সরঞ্জাম বা ওষুধ বা উপবাস ব্যবহার করে ইঁদুরের দেহে অটোফেজি প্রক্রিয়াটি চালু করেছে এবং সেই ক্ষেত্রে প্রাণীরা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে এবং সামগ্রিকভাবে আরও ভাল অবস্থায় থাকে।”

তবে, এটি কীভাবে মানুষের সাথে তুলনা করা হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে মত দিয়েছেন তিনি। 

ডাঃ রুবিনসটেইনের মতে, “ইঁদুরের মধ্যে, আপনি ২৪ ঘন্টার মধ্যে মস্তিষ্কে উপবাসের প্রভাব দেখতে পান এবং তাদের শরীরের কিছু অংশে, যেমন লিভার, অনেক বেশি দ্রুত। যদিও আমরা জানি রোজা রাখা উপকারী, আমরা জানি না তবুও মানুষের উপকারগুলো দেখতে কতক্ষণ রোজা রাখতে হবে।”

তিনি বলেন, উপবাস (রোজা) অটোফেজিকে উদ্দীপিত করে এবং এর উপকারিতা অন্যান্য গবেষণা দ্বারাও প্রমাণিত হয়েছে।

রোজা কি ক্যান্সার চিকিৎসায় উপকারী?

২০১৪ সালে ইঁদুরের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯-১২ ঘন্টার সময়কালের উপবাসে স্থূলতা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগের বিরুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। স্থূলতা ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই উপবাসের মাধ্যমে স্থূলতার বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখলে সেটি ক্যান্সার চিকিৎসায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। 

পরের বছর আরেক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, দ্বিমাসিক মিমিকিং (Mimicking) এর (উপবাসের একটি ধরণ) মাধ্যমে ইঁদুর এবং মানুষের মধ্যে ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা হ্রাস পেতে দেখেছেন তারা। 

২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাস এবং কেমোথেরাপির সংমিশ্রণ স্তন ক্যান্সার এবং ত্বকের ক্যান্সারের অগ্রগতি কমিয়ে দেয়।

অটোফেজি, ক্যান্সার চিকিৎসা ও বাস্তবতা

অনেক মানুষ আছেন অটোফেজি প্ররোচিত করার জন্য রোজা এবং ক্যালরি সীমাবদ্ধতা ব্যবহার করতে আগ্রহী, তবে মানুষের উপর এর সুনির্দিষ্ট প্রভাব সম্পর্কে খুব বেশি প্রমাণ নেই।

গবেষণায় দেখা গেছে যে ইঁদুরের অটোফেজি টিউমারের বৃদ্ধিকে সীমিত করতে পারে এবং ক্যান্সারের চিকিত্সার প্রতিক্রিয়া উন্নত করতে পারে।

গবেষকদের মতে, “ক্যান্সারে অটোফেজি একটি জটিল ভূমিকা পালন করে এবং এই পদ্ধতির দ্বারা উপকৃত হতে পারে এমন রোগীদের শনাক্ত করার জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ রয়েছে।”

বিজ্ঞানীদের কাছে অটোফেজির স্বাস্থ্যগত প্রভাবের সম্পূর্ণ চিত্র নেই, বা কীভাবে ব্যক্তিরা এটিকে প্ররোচিত করতে পারে সে সম্পর্কেও ধারণা করা যাচ্ছে না কারণ অটোফেজি বিষয়ে বেশিরভাগ গবেষণাই হয়েছে অন্যান্য প্রাণীর উপর। 

যে কেউ অটোফেজি পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন করার বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করলে, অবশ্যই আগে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। 

মূলত, ২০১৬ সালে অটোফেজি নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান ইয়োশিনোরি ওহশোমি। অটোফেজি মানবদেহের একটি চলমান প্রক্রিয়া। রোজা বা উপবাসসহ নানান উপায়ে এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট সময় রোজা রাখলে অটোফেজি চালু হয় এবং রোজার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয় বলে প্রমাণ দিয়েছেন ইয়োশিনোরি এমন দাবিতে ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। ইয়োশিনোরির বর্তমান কর্মস্থল টোকিও ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিও ইয়োশিনোরির নামে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন। তবে রোজা ক্যান্সার চিকিৎসায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে। 

সুতরাং, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমির গবেষণা দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img