সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কার করে কোটা ব্যবস্থার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা গত পহেলা জুলাই থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে গত ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়েও কথা বলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হন। এর প্রেক্ষিতে আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ঘটেছে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা, এসেছে বহু হতাহতের খবরও।
এরই প্রেক্ষিতে মূল ধারার গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলোকে উদ্ধৃত করে এই আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ১৭০০ ছাড়িয়ে গেছে শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের ঘটনায় সারাদেশে নিহতের সংখ্যা ১৭০০ ছাড়িয়েছে দাবি করে দৈনিক প্রথম আলো কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি বরং কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত আজকের (২৮ জুলাই) প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২১০ জনের মৃত্যুর তথ্য জানা যায়। এছাড়া এই আন্দোলনে ১৭০০ জন নিহত হওয়ার দাবির স্বপক্ষে বাংলাদেশ কিংবা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কোনো সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানের শুরুে দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করে আলোচিত দাবি সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা সংবাদ পাওয়া যায়নি।
তবে, গতকাল (২৭ জুলাই) “কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত: নিহত বেড়ে ২১০”- শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের ঘটনায় সারাদেশে এখন পর্যন্ত ২১০ জন নিহত হয়েছেন।
এরমধ্যে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই ৬ জন, ১৮ জুলাই ৪২ জন, ১৯ জুলাই ৮৫ জন, ২০ জুলাই ৩৮ জন, ২১ জুলাই ২১ জন, ২২ জুলাই ৫ জন, ২৩ জুলাই ৩ জন, ২৪ জুলাই ৩ জন, ২৫ জুলাই ৫ জন ও গতকাল ২৬ জুলাই ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার থেকে শনিবার পর্যন্ত সব মৃত্যু চিকিৎসাধীন অবস্থায় হয়েছে।
এছাড়া, আজকের (২৮ জুলাই) প্রথম আলো’র প্রিন্ট সংস্করণে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ২১০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে দাবিটির সূত্রপাত অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ফেসবুক মনিটরিং টুল ব্যবহার করে দেখা যায়, গত ২৪ জুলাই থেকে দাবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। গত ২৪ জুলাই প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন-১, ২।
পরবর্তীতে গত ২৪ জুলাই থেকে আজ (২৮ জুলাই) পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রথম আলো’র প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত নিহতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, প্রথম আলো ২৪ জুলাই ১৯৭ জন, ২৫ জুলাই ২০১ জন, ২৬ জুলাই ২০৪ জন, ২৭ জুলাই ২০৯ জন এবং সর্বশেষ আজ (২৮ জুলাই) ২১০ জন নিহতের তথ্য প্রকাশ করেছে।
এছাড়া, গত ২৪ জুলাই থেকে দাবিটি ইন্টারনেটে প্রচার করা হলেও সেদিন রাতে গণমাধ্যমটির অনলাইন বিভাগের প্রধান শওকত হোসেন মাসুম রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছিলেন, “ আমাদের কাছে থাকা সর্বশেষ তথ্য (২৪ জুলাইয়ের) অনুযায়ী ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন।”
পাশাপাশি, আলোচিত দাবির সপক্ষে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যম বা বিশ্বস্ত সূত্রে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, গত ২২ জুলাই ‘দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি’ শীর্ষক শিরোনামে একটি বিবৃতিতে সমন্বয়করা ‘তিন শতাধিক’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার অভিযোগ করেন।
এছাড়া, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে নিহতের সংখ্যা সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশীয় গণমাধ্যম নিউ এজ অন্তত ২১২ এবং ডেইলি স্টার ১৬২ এবং বণিক বার্তা ২০৮ জন নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা প্রায় দেড় শতাধিক আন্দোলনকারী, এএফপি অন্তত ২০১, বিবিসি নিউজ অন্তত ১৫০ জন, বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে অন্তত ১৫০ জন নিহতের তথ্য প্রকাশ করেছে।
মূলত, গত কিছুদিন ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারাদেশ ছিল উত্তাল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাঝে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। শেষ দিকে আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদেরও অংশগ্রহণের অভিযোগ উঠে। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে বহু হতাহতের ঘটনারও সংবাদ পাওয়া যায়। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলোকে উদ্ধৃত করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে সারাদেশে ১৭০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম আলোকে জড়িয়ে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা। গণমাধ্যমটি উক্ত সংখ্যা উল্লেখ করে কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি। কোটা আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রথম আলো কর্তৃক সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এখন পর্যন্ত ২১০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, পূর্বে প্রথম আলোকে উদ্ধৃত করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ৯০০ জনের বেশি নিহত হওয়ার দাবি ছড়িয়ে পড়লে সেটি নিয়েও ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, প্রথম আলোকে উদ্ধৃত করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ১৭০০ ছাড়িয়ে গেছে মর্মে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা।