বোরকা-নামাজের বিরোধিতা করে মন্তব্য করেননি পিইউএসটি শিক্ষক

সম্প্রতি “বোরখা-নামাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয় : পিইউএসটি শিক্ষক” শীর্ষক শিরোনামে একটি সংবাদ মূলধারার জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে

প্রতিবেদনটির সূত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে। 

পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বোরখা-নামাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয় এমন কোনো মন্তব্য পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রওশন ইয়াজদানী করেননি বরং শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষক রওশনের কথপোকথনের একটি অংশকে বিকৃত করে দেশীয় গণমাধ্যম নয়াদিগন্তে প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনে তাকে ইংরেজি বিভাগের ডিন হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও তিনি মূলত বিভাগটির শিক্ষক।

“বোরখা-নামাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়: পিইউএসটি শিক্ষক” শীর্ষক সংবাদটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী, ভুক্তভোগী শিক্ষক রওশন ইয়াজদানী ও বিশ্ববিদ্যালয়টির জনসংযোগ দফতরে যোগাযোগ করে।

এ বিষয়ে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান সোহান বলেন, ‘স্যারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি এসেছে তা সত্য নয়। ক্যাম্পাস ছোট হওয়ায় আমাদের একাডেমিক ভবনের পাশেই মসজিদ৷ আমরা দেখেছি ক্লাসের সময় যখনই আজান হয়, স্যার পড়ানো বন্ধ করে দেন৷ আজান শেষ হলে আবার শুরু করেন৷ কোনো সময়েই স্যার থেকে ধর্ম বিরোধী কোনো কথা শুনিনি।’

২৪ সেপ্টেম্বর, ঘটনার দিন শিক্ষক রওশন ইয়াজদানী যাদের ক্লাস নিয়েছিলেন সেই ইংরেজি বিভাগের ১ম বর্ষের ১ম সেমিস্টারের দুইজন শিক্ষার্থীর সঙ্গেও কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

তাদের একজন অলিউর রেজা মামুন রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ‘সেদিন আমি ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। এমন কিছুই স্যার সেদিন ক্লাসে বলেননি। যেই নিউজটা হয়েছে, সেটা মিথ্যা।’ 

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে অলিউর রেজা মামুন বলেন, ‘আমাদের ব্যাচের তিনজন শিক্ষার্থী জোহরের নামাজ পড়তে বাইরে যায়। দেড়টার পরে ওরা ক্লাসে আসে। ততক্ষণে স্যারের ক্লাস ১০-১৫ মিনিট পার হয়ে যায়। তারপর ওরা ক্লাসে আসলে স্যার ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে কোথায় গিয়েছিলে? ওরা উত্তরে নামাজ পড়তে গিয়েছিল বলে জানায়৷ স্যার তখন বলছিলো গুড। এরপর স্যার নামাজ পড়তে কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করলে ওরা জানায়, মেয়েদের হলে। তারপর স্যার বলে, আচ্ছা ঠিক আছে বসো। এর বেশি এ নিয়ে কোনো কথা হয়নি।’

এছাড়া নয়াদিগন্তে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী শিক্ষক রওশন ইয়াজদানী প্রেজেন্টেশনের দিন ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যই শাড়ি পরিধান করে আসতে হবে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন কিনা তা জানতে চাওয়া হলে অলিউর রেজা মামুন বলেন, স্যার প্রেজেন্টেশনের দিনের পোষাক নিয়ে মেয়েদের উপর নিজ থেকে কিছু চাপিয়ে দেননি।

ব্যাচটির আরেক শিক্ষার্থী সায়মা জানান, আমাদের ব্যাচে ৩৯ জন মেয়ে। দুইজন হিন্দু ছাড়া বাকী ৩৭ জন চার মাস ধরে বোরকা পরে ক্লাস করতেছি। স্যার যদি কিছু বলতো, আমাদের কি ক্লাস করা সম্ভব ছিল? আমাদের সিনিয়ররাও যার যার ধর্ম অনুযায়ী, পোষাক পরিধান করেন, বোরকা পরেন। নামাজের বিষয়ে স্যার উৎসাহিত করেন। যা বলা হয়েছে, ভুল বলা হয়েছে। 

এছাড়া ২৪ সেপ্টেম্বরের ঘটনা নিয়ে তার বক্তব্যের সঙ্গে অলিউর রেজা মামুনের বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের “‘বোরখা-নামাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ” শীর্ষক শিরোনামে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদে দপ্তরটির  উপ-পরিচালক মোঃ ফারুক হোসেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়। 

বিজ্ঞপ্তিটি থেকে জানা যায়, “গত ২৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তের অনলাইন সংস্করণে ‘বোরখা নামাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়’ শীর্ষক সংবাদটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সংবাদটি প্রত্যাখান করছে। প্রকৃতপক্ষে ঐ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বা বাইরে কোথাও এ ধরনের কথা বলেননি। বলার সুযোগও নেই। শ্রেণিকক্ষে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর সামনে এ ধরনের কথা বললে বিষয়টি অন্যরকমভাবে প্রচার পেত, কিন্তু শুধুমাত্র দৈনিক নয়া দিগন্তে সংবাদটি প্রচারের পিছনে অসৎ উদ্দেশ্য বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার পাশাপাশি ধর্মীয় ইস্যুকে উসকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার মৌলবাদীদের অপচেষ্টা এখানে আমরা দেখতে পাই। একজন জনপ্রিয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঘৃণ্য অপবাদের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।”

বিজ্ঞপ্তিটি সম্পর্কে জানতে দপ্তরটির  উপ-পরিচালক মোঃ ফারুক হোসেন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, বিজ্ঞপ্তিটি সত্য। 

এছাড়া তিনি বলেন, নয়াদিগন্তের সংবাদে তাকে ডিন উল্লেখ করা হলেও তিনি আসলে ডিন নন, তিনি ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান। ইংরেজি বিভাগ কলা অনুষদের অন্তর্ভুক্ত। যার ডিন ড. মুহাম্মদ হাবিবউল্লাহ। 

পাশাপাশি এ বিষয়ে জানতে ভুক্তভোগী শিক্ষক রওশন ইয়াজদানীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘ঘটনাটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, সেটিই আমার বক্তব্য।’

মূলত, গত ২৪ সেপ্টেম্বর পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তিন নারী শিক্ষার্থী জোহরের নামাজে পড়তে ক্লাসের বাহিরে যান। নামাজ থেকে ফিরে আসার পর ক্লাসে থাকা শিক্ষক রওশন ইয়াজদানীর সঙ্গে তাদের কথোপকথন হয়। উক্ত কথোপকথনকেই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে সংবাদ প্রচার করে মূলধারার জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্ত। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে গণমাধ্যমটি সংবাদটি তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেললেও সংবাদটির একটি স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার দিন ক্লাসে উপস্থিত থাকা পিইউএসটি ইংরেজি বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী প্রচারিত সংবাদটি সত্য নয় বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন।

প্রসঙ্গত, নয়া দিগন্তে ভুক্তভোগী শিক্ষককে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর এ ঘটনায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা প্রকাশিত সংবাদটিকে ষড়যন্ত্রমূলক, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত হিসেবে উল্লেখ করেন। 

সুতরাং, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রওশন ইয়াজদানীর মন্তব্য দাবি করে দেশীয় গণমাধ্যম নয়াদিগন্ত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র 

Conversation with PUST students 

Conversation with PUST PRO and Teacher

Somoy Tribune: সংবাদ প্রকাশের প্রতিবাদে পাবিপ্রবিতে মানববন্ধন
The Daily Campus: পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন

আরও পড়ুন

spot_img