জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’কে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
উক্ত দাবিতে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ে শীর্ষক কোনো সংবাদ প্রথম আলো প্রকাশ করেনি বরং প্রথম আলোকে জড়িয়ে ভুয়া এই তথ্যের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রমাণ মেলেনি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ২০২০ সালের ০৮ ডিসেম্বর “এটি ভুল, নাকি অনিয়ম” শীর্ষক শিরোনামে প্রথম আলো’য় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় এমন প্রায় দুই হাজার জনের তথ্য পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাঁদের জন্ম (পরিচয়পত্রের তথ্যে) মুক্তিযুদ্ধের পরে। ভুলে এমনটি হয়েছে, নাকি অনিয়ম–জালিয়াতি করে কারও কারও নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ঢুকেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রায় দুই হাজার জনের বয়স ৫০ বছরের কম হওয়ার কারণ কী, তা তদন্ত করে দেখা হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার (গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসাবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর।
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য এবং সরকার অনুমোদিত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই করেই ভাতাপ্রাপ্ত সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামের একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করেছে। নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয় লাল মুক্তিবার্তা, ‘ভারতীয় তালিকা’ ও ‘গেজেট’। এতে দেখা গেছে, ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা পাঠানো হতো। কিন্তু এমআইএসে তাঁদের নামসহ অন্যান্য তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার পর সংখ্যাটি ১ লাখ ৭১ হাজার হয়ে যায়। এখন এই ১ লাখ ৭১ হাজারের মধ্যে প্রায় দুই হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার বয়সে গরমিল পেয়েছে মন্ত্রণালয়। পরিচয়পত্র অনুযায়ী, যাঁদের বয়স ৫০ বছরের নিচে।
এই প্রতিবেদনে ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ এর পরে শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, এই বিষয়ে প্রথম আলো কর্তৃক প্রকাশিত অন্য কোনো প্রতিবেদনেও এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রথম আলোর অনলাইন বিভাগের প্রধান শওকত হোসেন রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, ‘৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ‘৭১ এর পরে’ শীর্ষক শিরোনামে বা এমন কোনো তথ্যে প্রথম আলো কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি।
৫৫ হাজার সংখ্যাটির সাথে মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না তা যাচাই করতে অধিকতর অনুসন্ধান করলে মূলধারার অন্য আরেকটি গণমাধ্যম যুগান্তরে প্রথম আলো কর্তৃক প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদন প্রকাশের চারদিন পূর্বে ২০২০ সালের ০৪ ডিসেম্বর “গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: যাচাই হবে ৫৫ হাজার সনদ” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গেজেটভুক্ত প্রায় ৫৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার সব ধরনের তথ্য ফের যাচাই-বাছাই করা হবে। এ জন্য উপজেলায় ৪ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব মুক্তিযোদ্ধা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে (২০০২-১৪) তালিকাভুক্ত হন। কিন্তু সেই সময় ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২’ অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। এসব বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই কমিটির কাছে নিজেদের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলে তাদের গেজেট বহাল থাকবে। অন্যথায় গেজেট সনদ বাতিলের পাশাপাশি ভাতাও বন্ধ হবে।
তবে, এই যাচাই-বাছাইয়ের পরবর্তী সময়ের সিদ্ধান্তমূলক কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি৷
মূলত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুসারে, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম আলো এমন তথ্যে কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি। তবে ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় এমন প্রায় দুই হাজার জনের তথ্য পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাঁদের জন্ম (পরিচয়পত্রের তথ্যে) মুক্তিযুদ্ধের পরে শীর্ষক দাবিতে একটি সংবাদ প্রথম আলো প্রকাশ করেছিল যা দাবিকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। তাছাড়া, উক্ত প্রতিবেদনেও উল্লিখিত প্রায় দুই হাজার জনের বিপক্ষে জালিয়াতি করার কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। বরং তদন্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
সুতরাং, ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ‘৭১ এর পরে শীর্ষক দাবিতে প্রথম আলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo – এটি ভুল, নাকি অনিয়ম
- Jugantor – গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: যাচাই হবে ৫৫ হাজার সনদ
- Statement of Shawkat Hossain, Head of Online, Prothom Alo
- Rumor Scanner’s own analysis