সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার হ্যাটেরাস সমুদ্র সৈকতে একটি সুন্দর এবং বিরল গোলাপি ডলফিন দেখা গিয়েছে দাবিতে গোলাপি কালারের ডলফিনের কিছু ছবি সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।
উক্ত ছবিগুলোসহ ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার হ্যাটেরাস সমুদ্র সৈকতে বিরল গোলাপি ডলফিন দেখা গিয়েছে দাবিতে প্রচারিত ছবিগুলো বাস্তব নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির সহায়তায় ছবিগুলো তৈরি করা হয়েছে।
ছবিগুলোর সম্ভাব্য সূত্রপাত খুঁজতে গিয়ে গত ১৮ জুন বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ১৮ মিনিটে ‘Outer Banks Vibes’ নামের একটি ফেসবুক পেজে একই ছবিগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত পোস্টের ক্যাপশনে ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছে, “উত্তর ক্যারোলিনার উপকূলে বিরল গোলাপি ডলফিন দেখা গেছে।” তবে পোস্টে ছবিগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে উক্ত ছবিগুলোর বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে গত ২০ জুন ‘Kaitlyn Cooper’ নামের একটি ফেসবুক আইডিতে ‘Outer Banks Vibes’ নামের ফেসবুক পেজে দাবিকৃত গোলাপি ডলফিনের ছবিগুলো শেয়ার করে লেখা হয়, “২৮ হাজার শেয়ার, অ্যালেক্স লেক্স আবারও জিতে গেছেন”।
উক্ত পোস্টের সূত্রে ‘Alex Lex’ নামের একটি ফেসবুক আইডি খুঁজে পাওয়া যায়। গত ১৯ জুন নিজের ফেসবুক আইডিতে গোলাপি ডলফিনের একটি ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে অ্যালেক্স লেক্স লিখেছেন, “আপনার ফেসবুক ফিড গোলাপি ডলফিন দিয়ে ভরানোর জন্য দুঃখিত।”
একই দিন আরেকটি ফেসবুক পোস্টে অ্যালেক্স লেক্স লিখেছেন, “People be like : You must be stup!d to believe this AI bull💩. 2 days later: Wow, beautiful pink dolphin 🐬🩷”।
যার ভাবার্থ, মানুষ বলেছিল এআই দিয়ে বানানো ছবি কেউ বিশ্বাস করবে না, অথচ দুই দিন পর একই ছবি দেখে সবাই মুগ্ধ হচ্ছে।
গত ২০ জুন একই ফেসবুক আইডিতে গোলাপি ডলফিনের গলায় “ALEX LEX NEVER LIE (অ্যালেক্স লেক্স কখনও মিথ্যা বলে না)” শীর্ষক লেখাযুক্ত সাইনবোর্ড ঝুলানো ছবি পোস্ট করা হয়েছে।
পরবর্তীতে গত ২১ জুন ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস এবং ব্রাজিলের বিনিউজে আলোচ্য গোলাপি ডলফিন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট পোস্ট করে অ্যালেক্স লেক্স লিখেছেন, “আমার ডলফিন বিশ্ববিখ্যাত: আজ সকালে ভারত, ফিলিপাইনস, ও সিঙ্গাপুরের সংবাদে।”
অ্যালেক্স লেক্স নামের ফেসবুক আইডি থেকে প্রচারিত এসব পোস্টের ভিত্তিতে বুঝা যায়, গোলাপি ডলফিনের আলোচিত ছবিগুলো তিনি এআই দিয়ে তৈরি করেছেন।
পরবর্তীতে ছবিগুলো বাস্তব কিনা তা যাচাই করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ছবি শনাক্তকরণ ওয়েবসাইটের সাহায্য নেওয়া হয়। ওয়েবসাইটের বিশ্লেষণেও ছবিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে তৈরি বলে জানা যায়।
এছাড়া একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাও গোলাপি ডলফিনের এই ছবিগুলো এআই দিয়ে তৈরি জানিয়ে ফ্যাক্টচেক (১,২,৩) প্রকাশ করেছে। উত্তর ক্যারোলিনা মেরিন ফিশারিজ বিভাগের (ডিএমএফ) একজন প্রতিনিধি ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট ভেরিফাইকে নিশ্চিত করেছেন যে, উত্তর ক্যারোলিনায় সাম্প্রতিককালে কোনো গোলাপি ডলফিনের দেখা পাওয়া যায়নি।
বাস্তবে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্ব
আলোচ্য গোলাপি ডলফিনের ছবিগুলো এআই দিয়ে হলেও বাস্তবে প্রধানত দুই প্রকারের গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে একটি হলো আমাজন নদীর ডলফিন, যা একটি মিঠা পানির প্রজাতি এবং শুধু দক্ষিণ আমেরিকার নদীগুলিতে পাওয়া যায়। অন্যটি ইন্দো-প্যাসিফিক হাম্ব্যাক ডলফিন, যা এশিয়ার উপকূলীয় পানিতে পাওয়া যায়।
সমুদ্র সংরক্ষণ এবং গবেষণা নিয়ে কাজ করা ব্লু ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, মানুষের মতো, বোতলনোজ ডলফিনও জেনেটিক মিউটেশনের কারণে অ্যালবিনো হতে পারে, যা তাদের ত্বকের কোষগুলোকে মেলানিন উৎপাদন করতে বাধা দেয়। অ্যালবিনো বোতলনোজ ডলফিনগুলির ত্বক গোলাপি বা সাদা হয়। অ্যালবিনিজম একটি বিরল অবস্থা এবং বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০টি অ্যালবিনো বোতলনোজ ডলফিন রেকর্ড করা হয়েছে। আলবুস অ্যাড্রিয়াটিক এবং ভূমধ্যসাগরীয় সাগরে প্রথম রেকর্ড করা অ্যালবিনো বোতলনোজ ডলফিন।
এছাড়া, ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গোলাপি রঙের অ্যালবিনো বোতলনোজ ডলফিন দেখার খবর পাওয়া যায় (১,২,৩)।
মূলত, সম্প্রতি নর্থ ক্যারোলিনার হ্যাটেরাস সমুদ্র সৈকতে বিরল গোলাপি ডলফিন দেখা গিয়েছে দাবিতে কিছু গোলাপি ডলফিনের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলো এআই দিয়ে তৈরি। ছবিগুলো ‘Alex Lex’ নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী তৈরি করেছেন। এছাড়া উত্তর ক্যারোলিনা মেরিন ফিশারিজ বিভাগের প্রতিনিধি একটি ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইটকে নিশ্চিত করেছেন, সাম্প্রতিককালে কোনো গোলাপি ডলফিনের দেখা মেলেনি। তবে বাস্তবে, আমাজন নদীর ডলফিন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক হাম্ব্যাক ডলফিন নামের দুটি প্রজাতি গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া অ্যালবিনিজমের কারণে কিছু বোতলনোজ ডলফিন গোলাপি হতে পারে।
সুতরাং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি কিছু ছবিকে নর্থ ক্যারোলিনার হ্যাটেরাস সমুদ্র সৈকতে গোলাপি ডলফিন দেখা গিয়েছে দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s analysis.
- Facebook post by Alex Lex.
- Snopes – Real Pics of Pink Dolphin Seen Off North Carolina Coast?
- Fact Crescendo Sri Lanka – The Viral Pictures Of The “Pink Dolphin” Are NOT Real
- Newsweek – Fact Check: Have Pink Dolphins Been Seen in North Carolina?
- Verify – Pink dolphins exist, but these photos claiming to show one in North Carolina are fake
- WDC – There are two species of “pink” dolphins that are found in very different parts of the world.
- Blue World Institute – Albus –the Adriatic white bottlenose dolphin
- The Guardian – Rare pink bottlenose dolphin surfaces in Louisiana lake
- New Scientist – Japan’s jumping pink dolphin is one of a kind
- Sun Herald – Fisherman spots elusive pink creature swimming off Louisiana. ‘Like I just saw Bigfoot’