গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলিতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ফটকের সামনে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নিহত আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
বুক পেতে দেয়া আবু সাঈদকে স্বল্প দূরত্ব থেকে পুলিশের গুলি চালানো এবং একাধিক গুলিতে বিদ্ধ হয়ে আবু সাঈদের রাস্তায় নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ার ভিডিও সেদিনই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
সম্প্রতি, একটি ছবি প্রচার করে ছবির ব্যক্তিকে আবু সাঈদ হিসেবে দাবি করে বলা হচ্ছে, “রাবার বুলেট লাগার পর আবু সাঈদের সঙ্গী সাথীরা তাকে এইভাবেই হাঁটিয়ে নিয়ে যায় কোন এক অজ্ঞাতস্থানে। বাম পাশ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি তার পেটের কাছে চামড়ার নিচে তিনটি রাবার বুলেট ঢুকেছে, যেখান থেকে কোন রক্তক্ষরণ হচ্ছে না। ডানদিকে বোধ করি একই অবস্থা হবে। সুস্থভাবে হেঁটে যাওয়া একটি মানুষকে পাঁচ ঘন্টা পরে কেন মৃত অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো ? এই পাঁচ ঘন্টা সে কোথায় ছিলো? কি অবস্থায় ছিলো?”
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যে ছবিটি প্রচার করে আবু সাঈদের ছবি দাবি করা হয়েছে, সেটি আবু সাঈদের ছবি নয় এবং এই ছবির সাথে প্রচারিত তথ্যও ভুয়া। প্রকৃতপক্ষে, ছবির আহত শিক্ষার্থী হচ্ছেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ১৫তম ব্যাচের মোঃ নাইমুল ইসলাম।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম ছবির মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের কোনো একটি ব্যাচের টিশার্ট পরিহিত একজনকে দেখতে পায়, সেই সূত্রে আবু সাঈদের পরিচিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ মুকুল মিয়ার সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে ছবির ব্যক্তি আবু সাঈদ কি না সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়।
জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে মোঃ মুকুল মিয়া রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ছবির ব্যক্তি আবু সাঈদ নন। ওর নাম নাইমুল, অর্থনীতি বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ, তার এক পাশে জার্সি পরা সৈকত, অর্থনীতি ১৫তম ব্যাচ, অপর পাশে টিশার্ট পরা সবুর, অর্থনীতি ১৫ তম ব্যাচ। পরবর্তীতে তার মাধ্যমে নাইমুল ইসলামের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে আমরা তার সাথে কথা বলি। নাইমুল জানায় ছবিটি তার, ছবিটি সেদিন তার এক বন্ধু তুলেছিলেন।
বিস্তারিত বক্তব্যে রিউমর স্ক্যানারকে নাইমুল জানায়, “আমি নাইমুল ইসলাম। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। আমি এই মর্মে সকলের উদ্দেশ্যে জানাচ্ছি যে উক্ত ছবির ব্যক্তিটি আমি। একদল কুচক্রী মহল আমার এই ছবিটি দিয়ে শহীদ আবু সাঈদ ভাই বলে চালিয়ে দিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব এবং বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় অপপ্রচার করছে। আমি আবারও দৃঢ়ভাবে বলছি, শহীদ আবু সাঈদ ভাই আমার ক্যাম্পাসের সিনিয়র ভাই ছিলেন, আর এই ছবির ব্যক্তিটি আমি। গত ১৬ জুলাই যখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেইট, যা বর্তমানে শহীদ আবু সাঈদ গেইট নামে পরিচিত সেখানে, আনুমানিক ২:১৬ মিনিটের দিকে পুলিশ হামলা চালালে আমি পুলিশের লাঠিচার্জ এর স্বীকার হই এবং ১৪ টি রাবার বুলেটে বিদ্ধ হই। যার দাগ এখনো আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট। আমি সকলের কাছে অনুরোধ করবো, আমার এই ছবিটি নিয়ে যেন আর অপপ্রচার না হয়।”
নাইমুল ইসলামের সাহায্যে আমরা কথা বলি ছবিটির চিত্রগ্রাহক শফিউল্লাহ কনকের সাথে। রিউমর স্ক্যানারকে শফিউল্লাহ কনক জানায়, “ছবির ব্যক্তিটি আমার বন্ধু নাইমুল, যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। ছবিটি ১৬ জুলাই ২০২৪, দুপুর ২ টা ২২ মিনিটে ধারণ করা। আমার বন্ধু আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হলে আমি সহ আমার আরো দুজন বন্ধু, সৈকত, সবুর এর সহায়তায় তার মেসের দিকে নিয়ে যাই। এবং সে ঐ সময় বিভিন্ন টিভিতে সাক্ষাৎকার দেয়। ঠিক ঐ মুহুর্তেই আমি আমার মোবাইল ফোন দিয়ে ছবিটি তুলি। এই ছবিটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর ফেসবুক পোস্ট, মিথ্যা প্রচারনা না চালানোর জন্য অনুরোধ করছি।”
শফিউল্লাহ কনকের থেকে আমরা ছবিটির মূল ফাইল ইমেইলের মাধ্যমে নিয়ে মেটাডাটা চেক করার মাধ্যমে এবং তার ফোনের ছবির মূল ফাইলের ডিটেইলসের স্ক্রিনশট নেয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি যে ছবিটি গত ১৬ জুলাই দুপুর ২:২২ মিনিটে তোলা হয়।
অর্থাৎ, সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত ভিন্ন এক শিক্ষার্থীর ছবিকে আবু সাঈদের ছবি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে।
উক্ত পোস্টে মোঃ নাইমুল ইসলামের আহতাবস্থার ছবি আবু সাঈদের হিসেবে প্রচারের সাথে ‘সুস্থভাবে হেঁটে যাওয়া আবু সাঈদকে ৫ ঘন্টা পর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দাবি করা হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে এ দাবিটি ভুয়া হিসেবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আবু সাঈদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রদত্ত মৃত্যুর মৃত্যুর প্রমাণপত্রে অনুযায়ী আবু সাঈদকে ১৬ জুলাই দুপুর ৩.০৫ মিনিটে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
অপরদিকে একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় একাধিক গুলি শরীরে বিদ্ধ হলে আবু সাঈদ নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ে। আমরা আবু সাঈদের রাস্তায় ঢলে পড়ার সময়কাল নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি খুঁজতে গিয়ে সেদিনের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির ফেসবুক পেজের একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। গত ১৬ জুলাই দুপুর ২ টা ১৬ মিনিটের সে লাইভের ১ম মিনিটের শেষাংশে আবু সাঈদের ফুটেজ পাওয়া যায়। এই লাইভ ভিডিও অনুযায়ী আবু সাঈদ দুপুর ২ টা ১৮ মিনিটে নিস্তেজ হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়েন।
এরপর আবু সাঈদকে কয়েকজন এসে হাত-পা ধরে রংপুর পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান এবং সেখান থেকে রিকশা করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নেয়ার আগেই আবু সাঈদের মৃত্যু ঘটে। আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়ের কিছু ছবি আমরা খুঁজে পেয়েছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি রিকশায় আবু সাঈদের নিথর দেহকে পার্কের মোড় এলাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আবু সাঈদকে রিকশা করে নিয়ে যাওয়ার সময়ের তেলা একটি ছবির টাইমফ্রেমে দেখা যায় ছবিটি ২:২৭ মিনিটে তোলা।
অর্থাৎ, হেঁটে যাওয়া আবু সাঈদকে ৫ ঘন্টা পর নয় বরং নিস্তেজ অবস্থায় তার লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথেই রিকশা করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার যাত্রা শুরু হয়।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ভাষায় আবু সাঈদের মৃত্যু
আবু সাঈদের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাঈদের মুখ থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির চিহ্ন। ছররা গুলি ঢুকে তাঁর শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অংশে গর্ত তৈরি করেছিল। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর মাথার বাঁ দিকেও আঘাতের কারণে রক্তজমাট ছিল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আবু সাঈদের খাদ্যনালি ও ঊরুর রক্তনালি জখমের কারণে রক্তজমাট বাঁধে। এই রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদ শকে চলে যান ও মৃত্যু ঘটে।
ময়নাতদন্তের বিষয়ে চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘অসংখ্য ছররা গুলির আঘাতে আবু সাঈদের শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয় এবং তার অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, আপনারা দেখেছেন যে সাঈদ ডান পায়ে হাত দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। তার ডান উরুতেও ছররা গুলি লেগেছি। সেখানে ফিমোরাল আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। তলপেটেও গুলির আঘাত ও রক্তক্ষরণ পেয়েছি। এসব আঘাতের কারণে শক ও রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।’
আবু সাঈদের মাথায় আঘাতের বিষয়ে রাজিবুল ইসলাম বলেন, তাঁর মাথার বাঁ দিকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সেটি তিনি পড়ে গিয়ে বা পারিপাার্শ্বিক অন্য কারণে হতে পারে। তবে এটি মৃত্যুর কারণ নয়। তাঁকে গুলি করা না হলে তাঁর মৃত্যু হতো না।
সুতরাং, কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত ভিন্ন আরেক শিক্ষার্থীর ছবিকে আবু সাঈদের ছবি দাবি করে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Statement of the Injured Student and his friends
- Statement of the photographer of the photo
- Rumor Scanner’s Investigation